ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পাঁচ
বাইরে চাঁদ কৃপণের মত আলো দিচ্ছে। পূর্ণিমা আসতে আরও দু’দিন বাকি। নতুন দেশের সব দেখব সব জানব—কিছুতেই যেন সবুর সইছে না। দূরের ঐ ছোট বড় টিলাপাহাড় এর মাঝের জমিতে যারা বাস করে তারা কারা? কি রকম ঐ প্রান্তের জমির রঙ—কি ফুল ফোটে, কি গাছের জঙ্গল ওই সব, কি ফসল হয়—এই সব প্রশ্ন নিস্প্রভ জ্যোৎস্নায় স্নাত হতে হতে জানতে ইচ্ছে করে। আগামী একপক্ষ জীবন জুড়ে কেবল ওই সুনীল জলধিই দেখবে সে।
নদী বেয়ে হাজির হল মাঝি। সে কিন্তু তেমনি আছে। গালে হালকা দাড়ি, পরনে চেক লুঙ্গি। তাকে দূর থেকে দেখে সোম প্রথমে ভেবেছিল আবার কোন কুষ্ঠরোগীদের নৌকা। ওরাই বলেছিল, আবার এক নৌকা আসবে, সে চাইলে তাতে উঠে পড়তে পারে। সামনে উপ-নির্বাচন আছে, সেখানে জিতবে হবে। তার জন্য লড়াই দিতে হবে।
অবাক হয়ে সোম বলে, “তুমি এখানে?”
সেও তেমনি অবাক হয়ে বলে, “তুমিই বা এখানে কি করছ? এই গ্রামে তোমার থাকার কথা তো নয়!”
সে নৌকা রেখে পাড়ে ওঠে। তারা এক গাছের নিচে বসে। দূরে দূরে যে সব চারা গাছ দেখা যাচ্ছে, তা সোমেরই হাতে রোপিত। পাহাড় থেকে, সমতল ভূমি থেকে যে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, সেই হিসেবে সোম বৃক্ষ রোপণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এবং এই কাজে সে যথেষ্ট সফল। তারিফ করে হানজালা বলে, “বাঃ, দারুণ কাজ! সত্যি তোমার এক আলাদা মন আছে, সোমবাবু।”
“আমিই এই অরণ্য সৃষ্টি করেছি। চোরাই কারবারিরা সব ফাঁক করে দিয়েছিল। এখন বন ঘন হয়েছে, কত পাখি আসে। তারা গাছে গাছে বসত করে।”
“আগে এখানে কী ছিল, জানো?”
“না। এখন অরণ্য আছে।”
“কিন্তু তুমি এতদূর চলে এলে কী করে?”
“নদীর ধারে আমি কোন ঘর দেখিনি। সেই ঘর, গাছ খুঁজতে খুঁজতে আমি উপস্থিত হই এমন জায়গায়, তার নাম মৃগভূমি! তারা সকলেই উদ্বাস্তু। তারা সকলে চাঁদের প্রতি লাভ দেয়। তাদের লক্ষ্য নির্বাণ।”
“দেখ, এখানে কিছু একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এই পথে কি মানুষ আসে, নাকি এটি পারাপারের খেয়া? নদীর ওপারে ধানজমি আছে—যারা পুব খাটতে আসে—তারা যায়। তাদের তো হরিণ হবার কথা নয়!”
“ওরা সব নিষাদ জাতি। ওরা রূপাঞ্জনার নাম শুনেছে—কিন্তু দেখেনি কোনদিন। ‘বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি’র মন্ত্র মন্দ্রিত কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে এটা তারা শোনে, কিন্তু বোঝে না কোনদিক থেকে তা আসছে।”
“এখানে তুমি কী করছ তবে?”
“আমি এখানে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তুলি—তার ফল তুমি দেখতেই পাচ্ছ। এখন তাই নিয়েই আছি। সঙ্গে আছে আমার স্ত্রী। তার নাম মৃগশিরা নক্ষত্র।”
“হুম! নক্ষত্র জাতের মেয়ে। বনের ওদিকে ওদের পাড়া আছে। তারা যেখানে যায় দলবেঁধে থাকে। কিন্তু সে তোমাকে বিয়ে করল কেন? আর তোমার সঙ্গে তার দেখা হলই বা কী করে? ওরা ঐ দূর টিলার মাথা টপকে এদিকে আসে না। বিনিময় প্রথায় ওদের সমাজ চলে, এদিকের সভ্য জগতের সঙ্গে ওদের কোন দরকার নেই। শুনেছি কিছুদিন আগে এক বিল্পবী ওখানে লুকিয়ে ছিল। ওরা নিজের জাতের ছেলে ছাড়া বিয়ে করে না।
“কিন্তু আমি তোমাকে ইচ্ছে করে ভুল পথে চালিত করিনি। তুমি চাঁদের মোহিনী আলোর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলে। এত উজ্জ্বল চাঁদ, আমি যে কখনও দেখিনি কেবল নয়, ঐ এলাকার কোন মানুষই দেখেনি। আনন্দে মানুষেরা হরিণ হতে শুরু করে। তাদের জাত ধর্ম বর্ণ সব পালটে যায়। সঙ্গে আবার এও ভেবেছি, নারীকে ছেড়ে তুমি ঢুকে গেছ বিহার কেন্দ্রে। সেই প্রবেশ তোমার এতটাই গভীরে যে দিনের পর দিন নৌকা নিয়ে স্থিত হয়েও আমি তোমাকে ফিরতে দেখি না। আমি নদীর পারে মাঝে মাঝেই সেইখানে নৌকা বাঁধতাম, যেখানে তুমি নেমেছিলে। তারপর একদিন নদীতে যখন পাক দিচ্ছি—এক সময় আমার নৌকার দাঁড়ে এসে বসল কতগুলি পক্ষী। ওরা আসলে পক্ষী জাতের মানুষ—আকাশে ওদের উড়তে দেখেছি—তুমিও শুনেছ ওদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ—নৌকায় যখন নদীকে পেরুচ্ছিলে।
কিন্তু তাদের সামনে দেখলাম সেই প্রথম। তারাই আমাকে বলে এক ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিহারের ভেতর অতি গোপনে বাস করা কুড়িজন সুন্দরী নারী পুতুলের কথা। ওরা সেই ক’জন মেয়েকেই চায়, কারণ ওরা নারী মিলনহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে বহুদিন। ওরা আমাকে প্রলোভন দেখায়। যদি গুহামুখ আমি খুঁজে পাই আর সেই নারীদের ওদের হাতে তুলে দিতে পারি, আমাকে অনেক ধনরত্ন দেবে। আমি ওদের সঙ্গে ঝামেলায় গেলাম না। বললাম, ‘খোঁজ এনে দোব, কিন্তু তার আগে আমাকে বিহারটা চেনাও।’ ওরা চেনাল। কিন্তু বিহারের গাত্রে কিছু অপূর্ব চিত্র ছাড়া আর কিছু মিলল না। আর সে গুহার কী মাধুর্য! চারিদিকে কেবল ছবি আঁকা। আমি শুনেছি এই এলাকায় একদা একদল অপ্সরা বসবাস করত।”
“ও কি বিবাহ করেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কাকে?”
“মাস্টারকে।”
“মাস্টার! ঠিক বুঝলাম না।”
“তুমি নিরুদ্দেশ হলে সে খুব ব্যাথিত হয়েছিল। তুমি ফিরলে না দেখে, মাস্টার ওকে বেশি করে সঙ্গ দিতে থাকল। একদিন দেখলাম, ওরা বিবাহ সম্পন্ন করল। মাস্টার নতুন বউ নিয়ে বাড়ি গেল এবং বিতারিত হল। মাস্টার জানত এমনটি হতে পারে। ও করেছিল কি, ঘিয়া নদীর ধারেই একটা ঘর গড়ে নিয়েছিল। সাধারণ ঘর, সাধারণ জীবনধারণ। সে নারীটি এন গ্রাম সৃষ্টি করতে ওস্তাদ। যাই হোক, এক গ্রাম ফেলে এসে অপর গ্রাম বানিয়ে সেখানেই তারা বসবাস আরম্ভ করলে। আমি মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে বসতাম।”
প্রসঙ্গ ঘোরাতে সোম বলে, “ তা, তুমি সেবার নিজের বিয়ে-সংসার নিয়ে কী সব বলবে বলেছিলে। সেই গল্প তো আর শোনা হল না।”
“আমার কথা আর কী শুনবে বল। আমি নৌকা বাই, নৌকাতেই রাত কেটে যায়—রাতের পর রাত। দিন আমার চোখে সাদা হয়ে ধরা দেয়, যেখানে কোন রঙ নেই, বরং রাত রঙ্গিন হয়ে ওঠে। একাকী নৌকা নিয়ে চরাচর, সমগ্র নদীকে প্রদক্ষিণ করি। মুঠো মুঠো নক্ষত্র ধরা থাকে আকাশে, চাঁদ এদিক ওদিক দুলে যায়। কখনও দেখি চাঁদ ফেটে যায় সেই হরিণের মতন। ফলে অনেক কথাই আমি জেনে যেতে থাকি, কত কিছু দেখে ফেলি—কত অজানা, অদেখা, রহস্যময়তা আমার কাছে সহজ হয়ে আসে। একদিন দেখি, ওই ভাঙ্গা বৌদ্ধবিহার উড়ে চলেছে শূন্যে। তার ভেতর কত আলো, কত রামধনু রঙ। বুদ্ধের সুর সারা আকাশকে মাতিয়ে তোলে। অজস্র হরিণ সেই উড়ন্ত চাকির মত বিহারকে ঘিরে পাক খায়। এখন এই যে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, এর চাইতে সত্যি আর কী আছে?”
তার হাতে কিছু ফল তুলে দেয় সোম। বিষহীন, জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা ফল পেয়ে সে খুশি হয়। বলে, “তুমি দেখি বেশ গুছিয়ে বসেছ, সোমবাবু। কিছু খচ্চরও পুষেছ দেখলাম।”
“খচ্চর! তার মানে?”
“ওরা তোমার ঘরের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে কিনা।”
“না! তেমন কোন ব্যাপার নেই। ওরা তবে হরিণ হতে পারে।”
“ও।”
“মাস্টার কি এখনও সেখানেই কাজ করছে?”
“না। বিবাহের পর সে কাজ ছেড়ে দেয়। আর এখন হোম বন্ধ হয়ে গেছে।”
“কেন?”
“রামবাবু মারা গেছে অনেকদিন হল। একদিন হোমের কাজের জন্য নিজের গাড়িতে পথে বেরিয়ে মাঝপথে আচমকাই বুকে ব্যাথা অনুভব করে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সব শেষ। সঙ্গে ছিল কেবলমাত্র গাড়ির ড্রাইভার। সে মুখে জল দেয়—তাই রক্ষে। রামবাবু নানা ধরণের ডাক্তার দেখত বটে, কিন্তু কিছুই মানত না। আমি বলতাম, আপনি অমন করেন কেন? হঠাৎ কিছু হলে? এত পয়সা আপনার—কে ভোগ করবে? সে বলে, মরার পর রেখে যাব। যাই হোক, বুড়ো মরল। তার ছেলে হোম চালাত। সে কথা আর কি বলব সোমবাবু—হোমে এখন নারী পাচার হয়। রামবাবু মারা যেতেই তার ছেলে দায়িত্ব নেয়। রামবাবু একজন নারীলোভী লোক ছিল বটে, কিন্তু সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। তার একজন বাঁধা মেয়েমানুষ ছিল, যা কিছু করার তার সঙ্গেই করত। সে তো কত পুরুষের থাকে। কিন্তু তার ছেলে কমলের বাপের মত হোম চালান, সরকারি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দক্ষতা—সেই ক্ষমতা নেই। সে যেমন এক মাথামোটা লোক, তার সঙ্গে তেমন শ্রেণির লোক জুটে যায়। তাদের পরামর্শে এই সব অনৈতিক কাজ তার ছেলে কিছু সাগরেদ নিয়ে শুরু করে। সঙ্গে চলে শিশু পাচার। হোমে কিন্তু শিশু রাখা হোত না। বুড়োর বেঁচে থাকার সময়েও নয়, আপনাদের সময়েও নয়। বুড়োর ছেলে সেটা শুরু করে। শিশু আনা হোত নার্সিংহোম থেকে—গরীব মায়েদের, কুমারী মেয়েদের, অধিক সন্তানের মায়েদের শিশু সব—মৃত শিশু জন্মেছে বলে তাদের সরিয়ে ফেলা হোত হোমে—পাচার হোত বিস্কুটের টিনের ভেতর। যে সব শিশু তার মধ্যে খিদের তাড়নায় বা দম বন্ধ হয়ে মারা যেত, সেই মৃত শিশুদের নদীর পারে পুঁতে দেওয়া হোত। জানাজানি হল, পুলিশ কেস হল। সে এখন জেলে।”
সোম বলে, “কিন্তু তুমি এখানে এলে কি করে? আর আমাকে খুঁজে বের করলেই বা কী করে?”
একটু হেসে হানজালা বলে, “সেটা কী এমন কিছু কঠিন কাজ? আমরা রাতচরা মানুষ। নদীই আমাদের কাছে ঘর-বার-দোর। কোথায় কখন কোন নদী জন্ম নিচ্ছে, কোন নদীই বা মারা যাচ্ছে, কোন নদীকে বেচে দেওয়া হচ্ছে বোতল ভর্তি জলের জন্য; কোন নদীকে বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে, কার জল আটকে রাখা হচ্ছে; কোন রাজ্য-কোন দেশ পর্যাপ্ত জল পাচ্ছে না—সব খবর আমরা রাখি। কতশত জলাভূমি রাতারাতি বুজিয়ে ঘরবাড়ি উঠে যাচ্ছে, জলাভূমি বাঁচাতে, চাষ জমি বাঁচাতে যে মানুষ লড়ছে—খুন হয়ে যাচ্ছে; তেমনি কতশত প্রতিবাদী মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে। সেই সব বিদেহীদের আমি নদী পার করে দিই। তারা তারপর কোথায় যায়, আমার জানা নেই!”
সোম বিনবিন করে বলে, “ওরাই তবে সেই উদ্বাস্তু! এই অঘ্রাণেই কি ওরা উদ্বাস্তু হল?”
হানজালা বলে যেতে থাকে নিজের মতন করে, “উদ্বাস্তু হবার কোন মাস আছে কি, সোমবাবু? গোটা দুনিয়া জুড়ে মানুষজন নানা কারণে এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। তাই আমি আর কোন ঘর গড়িনি। ইচ্ছে ছিল আবার ঘর গড়ব, বাঁধব—করিনি তা ইচ্ছে করেই। কারণ আর কিছুই নয় সোমবাবু। মানুষের নিজস্ব কোন বাসস্থান নেই।”
অঘ্রাণ মাস কি শেষ হয়ে গেল? সেই যে ধান কাটার মাস। কুয়াশা ঘেরা মাঠের মাস। শিশির পড়ে টুপটুপ। আকাশটা খুব ভারি হয়ে নিচে নেমে আসে তখন। কতবার সে সময় মনে হয়েছে, যাই গিয়ে ছুঁয়ে আসি। যাই আমি ছুটে গেছি, দেখি আকাশও ছুটে যায়। এখনও ধান ফলে মাঝি? সেই ধান কাটা হয়? সেখানে এখন ইঁদুর আছে। ধানের শীষ তারা তুলে নেয় মাঠ থেকে। আবার সেই ইঁদুরকে নেয় প্যাঁচার দল। সে যে বড় আমোদের মাস! এমন কত অঘ্রাণ পেরিয়ে এলাম আমি!
“তবে কী সে সব অঘ্রাণ শেষ হয়ে গেছে? এই পৃথিবীতে কতগুলি অঘ্রাণ মাস আছে, জান মাঝি?”
“না। তবে এটা বলতে পারি, তুমি এখনও অঘ্রাণের ঘেরে আছ, অঘ্রাণ চলছে। অঘ্রাণের পাকে পাকে অঘ্রাণ। এই মাস যখন তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে, তোমার এখানের বাস আর ভাল লাগবে না।”
“একটি মাস কতদিন ধরে চলে, হানজালা?”
“ধরে নাও না কেন, একটি মাত্র অঘ্রাণের ভেতর তুমি পাক খাচ্ছ। আর তার ভেতর ঘটে যাচ্ছে একটি উপ-নির্বাচন। তারপর আসবে গ্রামীণ ভোট। আর সেই নির্বাচন যতক্ষণ না শেষ হয়, গণনা হয়, জুয়োচুরি ধরা পড়েও পড়ে না, ততক্ষণ অবধি অঘ্রাণ চলবে।”
একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে সোম বলে, “আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, হানজালা। আমি কোন প্রতিবাদে নেই, প্রতিরোধে থাকি না—মোমবাতি মিছিল উঠে গেছে সেই কবে। সবাই এক দল এখন। হ্যাঁ, বর্তমান পরিস্থিতে সেটাই ঠিক। কি হবে মিছে প্রতিবাদ করে প্রাণ খুইয়ে? তাছাড়া আমার সংসার আছে। সেটাকে আমি ভাসিয়ে দিতে পারি না।”
ছয়
হানজালা সোমের সঙ্গে চলতে থাকে। মাঠ থেকে ঢুকে যায় বনের ভেতর। সেখানে সে কাঠ কাটে, বাঁশ কাটে। তার একটি বলিষ্ঠ নৌকা দরকার। আরও প্রয়োজনীয় উপাদান কেটে নিয়ে সে এক নতুন নাও বানাতে লেগে যায়।
“তুমি কোথাও চলেছ? কিসের প্র্যোজনের এতবড় নৌকা বানাও। সেদিনের ঐ উতুঙ্গ নদীকে তুমি সামলে দিলে ওই ভাঙ্গা নৌকাতে বসেই, তবে কিসের জন্য এতখানি বড় নাও বানাতে লেগে গেলে তুমি?”
“ধরে নাও, তোমারই কারণে।”
“কেন? আমি আর তোমার সঙ্গে নৌকায় ভাসছি না।”
“এখানে কি পেলে তুমি? ঘরে ফিরলে না, এক মায়াবী চাঁদের টানে, আলোর টানে, নারীকেই নক্ষত্র ভেবে বসলে! তবে কি আমার সঙ্গেই দেখা হওয়া কাল হল তোমাদের? মাস্টারের মত তুমিও ঘরছুট, আমিও ঘরছুট। আমরা কি তবে ঘরছুটদের পৃথিবীতে নিজের নিজের মত করে বাস করি?”
“কিন্তু এখানে তুমি এলে কী করে?”
“ঐ, যেমন হয়; ভাসতে ভাসতে চলে এসেছি। আবার জলে ভাসতে ভাসতে তেমনি কোথাও চলে যাব। পৃথিবী খুব ছোট সোমবাবু, আসলে আমরা ভাবি বড়। আমরা যদি কোন উঁচু স্থানে দাঁড়াই, দুনিয়ার এমুড়ো-ওমুড়ো দেখতে পাব। নতুন ভেলা বানিয়ে আমার এই পুরান নৌকাখানা তোমাকে দিয়ে যাব। এই দিয়ে তুমি নদীতে ভ্রমণ করতে পারবে।”
“এই নৌকা আমার কি কাজে লাগবে? ও তুমি নিয়ে যাও, হানজালা। আমি সাধারণ মানুষ। এই বেশ আছি। আমার কোথাও যাবার নেই।”
“যদি ধরে নাও, এই স্থান একদিন উড়ন্ত হবে শূন্যে, তখন এখান থেকে বেরুবার জন্য একখানা নাও লাগবে তোমার। সে তুমি কোথায় পাবে তখন? বুদ্ধের আমলের নাও দিয়ে কী সামলাতে পারবে এই সময়ের ঝঞ্ঝা? এই নৌকার কত কাজ। আর কাজ না রইল তো খই ভাজ। মানে বেরিয়ে আসবে।”
‘তুমি পৃথিবী ধংসের কথা বলছ? সেই জন্য আমার নৌকাতে কোন কাজ নেই হানজালা। কারণ এই নৌকাও একদিন ধূলি হয়ে যাবে।”
“তবে তো ধূলিকণা সত্য। তাহলে সত্য কি সোমবাবু?”
“সত্য সেই, সেটাকে আমরা সত্য বলে ধরে নিই।”
“বড় গোলমেলে কথা বলে ফেললে, সোমবাবু—” বলে হানজালা উঠে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে হাত তোলে। সে একটানা বলে, “আসলে হল কি জান, একদিন ভেলা নিয়ে জলের উপর স্থির হয়ে আছি, স্রোত যায়, মাছ যায়, সঙ্গে দেখি মৃতদেহ ভেসে যায়। প্রথমে একটি, পরে দেখি দলদল! আমি দেখে খুব ভয় পেয়ে যাই। আমি নিজে যে সব মানুষদের জলে ছেড়ে দিই, তারা জলহরিণ হয়ে জলের ভেতর বাস করে, মাঝে মাঝে তারা নদীর উপর দিয়ে খলবল করে দৌড়ে যায়। সে তুমিও দেখেছ, সোমবাবু। কিন্তু তাদের তো মৃতদেহ হবার কথা নয়।
“তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এরা কারা? এ কাদের দেহ? এত দেহ কোথা থেকে আসে? এত হত্যা কোথায় ঘটছে? কোথায় মানুষ আবার অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল? তাই বলে এর আগে নদীতে কি আমি শব ভেসে যেতে দেখিনি? কত দেখিছি। নদী নিয়েই আমার কারবার। তার জলে ভেসে মাঝ নদীতে স্থির না থাকলে আমার ঘুম আসে না, তুমি জান মালিক। শব ভেসে যায়, পানকৌড়ি ডুব গালে, শুশুক নাক উঁচিয়ে থাকে—নদীর ভেতর এ সব চলতেই থাকে। ওরা আর আমাকে ভয় পায় না, কারণ জানে এই লোকটা আমাদেরই—নদীর লোক।
“কিন্তু সেদিন অত দেহ দেখে আমি স্থির থাকতে পারিনি। নৌকা নিয়ে যেদিক থেকে দেহ আসছে সেদিকে যেতে থাকি। মনে হতে থাকে, কোন হত্যাকারী শতশত নিরীহ মানুষের শব ভাসিয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধ লেগেছে কোথাও। এরা সব উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ-শিশু! কেউ নিজের দেশেই উদ্বাস্তু। ধর্মের কারণে তাকে নিজ দেশ থেকে বিতারিত হতে হয়েছে। নৌকা নিয়ে পালাতে গিয়ে ডুবে মরেছে, নইলে মেরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শয়ে শয়ে তারা ভেসে আসছে। আরও নাকি আসবে। সব এসে মিলে যাচ্ছে নদীতে নদীতে। এক নদী মানেই সে হাজার নদী। এক নদীর জল গিয়ে পড়ে অন্য নদীতে। তাই সে নদীতে আমরা যাত্রা শুরু করি, সে নদী যদি আমাদের অন্য নদীতে এনে ফেলে বা অতীতের কোন নদীতে ঢুকে যায়—কিচ্ছু বলার নেই, নদী এমনি। এই সব ভাবছি আর এগুচ্ছি। এ সময় দেখি আজব ব্যাপার। এক শবদেহের উপর বসে আছে একজন ফকির। তার গায়ে নানা কাপড়ের জোব্বা। এই লম্বা সাদা দাড়ি। চুলে জট। চক্ষুবর্ণ তামাটে। তার পাশে একটি হরিণ। সে শব ছেড়ে আমার ভেলায় উঠে বসে। বলে, ‘নাও, এবার লগি ঠেল।’
“আমি কি তাঁকে দেখেছি?”
“হতেও পারে। তিনি একজন দরবেশ, দুনিয়াব্যাপী তাঁর কাজ।“
“তাই ভাবি! এক দরবেশের মাঝে ঢুকে যায় আর এক দরবেশ। তারপর কী হল, মাঝি?”
“আমি যেদিক থেকে এসেছিলাম আবার সেদিকেই ফিরে যেতে থাকি। আমি বললাম, ‘তুমি যাবে কোথায়? আর আসছই বা কোথা থেকে?’ সে গাঁজায় লম্বা এক টান দিয়ে বলে, ‘এই নদী বেয়ে বুদ্ধ আসছেন। চারিদিকে যেভাবে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে—তাই তাঁর আগমণ সুদূর বামিয়ান থেকে, বামিয়ান নদী বেয়ে—এক নৌকায়। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিনি এখন মৃগজন্ম নিয়ে লীলা করছেন কোন এক বনের মধ্যে। আরও বেশ কয়েকটি জন্মের পর আমরা তাঁকে পাব। এই হরিণটি আমি তাঁকে দিয়ে আমি যাত্রা করব রাকার পথে। ততদিন ততদিনে আমি তোমাদের এখানের এই সময়টাকে উপভোগ করব। তোমাদের এখানে নাকি ভাল আফিম মেলে? খুব সস্তায় পাওয়া যায়? সীমান্ত লাগোয়া জমিতে আফিম এইজন্য চাষ হয় যে তা সীমান্ত পার করতে সুবিধে হয়।”
কথা বলতে বলতেই হানজালা বাঁশ-কাঠের সহযোগে একটি মজবুত ভেলা বানিয়ে নিল। সত্যি, আগেরটা যে সে ছেড়েছে, সেটা খুব দরকার ছিল। নদীতে স্রোত অনেক। সেখানে এই ভেলা বেশিক্ষণ যুজতে পারবে না। হানজালা নদীর লোক। সে ভেলার ক্ষমতা বোঝে। বলে, “কোথায় গিয়ে ঠেকব জানি না।”
বুকের ভেতর এক অদ্ভূত অনুভুতি হতে থাকল সোমের। সে চুপ থাকল।
“আমি এবার যাব।” সে ভেলাখানা কাঁধে চাপিয়ে নেয়। “ফকিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটাই আমার জীবনে কাল হল। তার গেরুয়া বসন, মুখে অনাবিল হাসি। তার সঙ্গে রয়েছে এক আলোমাখা হরিণ। সেই হরিণ তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে।”
“সে কোন মহল্লার হরিণ? মৃগদাবের নাকি হরিণ মহল্লার?”
“সে আমি বলতে পারব না—তবে আমি বলব—তুমি এক মহান মানুষ। তুমি এক গ্রাম গড়ে তুলেছ যেখানে নিষাদদের পাশাপাশি অনেক দেশত্যাগী মানুষ বাস করছে। এখানে তারা আসল পরিচয় লুকিয়ে মৃগ পরিচয়ে বাস করছে। শুনেছি, সামনের গ্রামীণ নির্বাচনে তারা নাকি ভোটে দাঁড়াতে পারে। এখানে তারাই দলে ভারি। তাছাড়া এখন কোটা সিস্টেম চালু হয়েছে। নিষাদ জাতির একজনকে দাঁড় করাতে পারলে জয় আসবে!”
“তুমি কি সেই আলোর প্রতি চলেছ মাঝি?”
“বলতে পার, সোমবাবু। আর সেই মাদারি ফকির তো আলোর কাঙ্গাল। আলো দেখেই সে এসেছে। আলোই তার চালিকা শক্তি। সেই আলো থেকেই সে কুড়িয়ে নেয় এক হরিণ। বা বলতে পার, চাঁদের সেই আলো থেকে জন্ম নেওয়া এক হরিণ। সেই যে হরিণ ছিটকে গেল, তার টুকরোরা গেল দ্বিকবিদিক। তেমনই এক হরিণ তাকে পথ দেখিয়ে ভারতবর্ষে নিয়ে আসে।”
সাত
সেদিন রাতে সোম ঘুমন্ত মৃগশিরার বুকের নরমের ভেতর মুখ গুঁজে দেয়। কি অপূর্ব গন্ধ সেখানে! সে খেয়াল করে দেখেছে, এক এক দিন তার বুকের গন্ধ রকম রকম থাকে। সেই স্বাদ গন্ধের কাছে মুছে যায় হানজালা মোল্লা। মুছে যায় সমস্ত নদী গ্রাম জনপদ ও রূপাঞ্জনা। সে একটু একটু করে ওর শরীর আমি খুলে ফেলে। দেখে যেন আলো দিয়ে গঠিত সেই দেহ।
মৃগশিরা সোমের গলা জড়িয়ে নরম গলায় আস্তে আস্তে বলতে থাকে, “জানো, একদিন নদীকে দেখতে দেখতে বেখেয়ালে নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আছি, তখন এক অন্যতর অনুভব হল। আমার মনে হল সংসার অনেকটা এরকম, ঘন জঙ্গলের চারিদিকে আগুন জ্বলছে আর আমি মাঝে ঘর বানিয়ে বসে আছি। ভাবছি না যে এই আগুন আমাদের ঘরকেও ভস্ম করবে। যাকে আমি আপন মনে করে অনেক আদর করেছি সে কোথাও থাকবে আর আমি অন্য কোথাও থাকব। তখন আমার মনে হল, গত জন্মের কথা। এক দুর্ঘটনায় আমার স্বামী-পুত্র-পরিজন মারা যায়। তাদের একসঙ্গে চিতায় জ্বলতে দেখে শোকে পাগল হয়ে গেলাম, নিজের পরণের কাপড়ের কথা আর খেয়াল রইল না। সেই অবস্থায় আমি বুদ্ধের কাছে পৌঁছে গেলাম। আমি তখন বুঝলাম, যখল দেখলাম শ্রাবকেরা আমাকে উলঙ্গ চোখে গ্রাস করছে। আমি লজ্জায় উবু হয়ে বসে পরলাম। এই সময় একজন একটা কাপড় এনে দিল। সেটি পরে আমি শূন্য হয়ে গেলাম!”
সোম শিউরে উঠল। তার মনে পড়ল হানজালার কথা। নক্ষত্র জাতের মেয়েরা বেজাতের ছেলের সঙ্গে বেশিদিন সংসার করে না। তারা নিজ জাতের ছেলেদের কাছেই নাকি ফিরে যায়। নইলে তাদের আত্মার মুক্তি হয় না—এমন একটা ধারণা তাদের জাতে আছে। ফলে যে সময় সে এসেছিল, তা ছিল এক দুর্ঘটনা। ওরা ঝোরা নামিয়ে তাতে রবারের ভেলা ভাসিয়েছিল।
সোম মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল, “ও তোমার মনের ভুল!”
মৃগশিরা যুক্তি ভাবতে চুপ করে যায়। সেই অবসরে সোম একের পর এক ডুব দিতে থাকে তার শরীরে, যাতে সে শূন্য হবার প্রক্রিয়া ভুলে যেতে থাকে। যেন সে তাকে নতুন করে আবিস্কার করতে চায়। তাকে নতুন করে দেখতে চাই আজ, যেমন করে কোন পুরুষ প্রথম কোন নারীকে দেখে। অজস্র তারামন্ডলী তার যোনির ভেতর বাস করে বলেই সে এমন আলোকিত এক নারী। সোম ক্রমাগ্রত তাকে মন্থন করতে থাকে। দেখে তার দেহ ক্রমে হয়ে উঠছে নক্ষত্রপুঞ্জ!
যখন ঘুম ভাঙ্গল কত রাত জানে না সে। শরীর জুড়ে নক্ষত্রের নানা রঙের গুঁড়োর মাখামাখি। তার মনের ভেতর নৌকা জেগে ওঠে। কিন্তু দেহে এক প্রবল অস্বত্ত্বি হচ্ছিল। কিসের জন্য সেটা বুঝতে পারল না। বিছানা ছাড়তে বাধ্য হল এক অন্যতর গন্ধ বাতাসে। কেন জানি তার মনে হল, বাইরে আসা দরকার। কেননা ঘরের ভেতর বাতাস কমে যাচ্ছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। উঠে বসল সোম, সর্ন্তপণে দরজা খুলে বাইরে এল। সামনে তাকাতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। চাঁদের মেদুর আলোয় দেখল, তার উঠোন ঘিরে ছায়ার মত থাবা পেতে বসে আছে হাজার হাজার হরিণ!
এত হরিণ এখানে কী করছে? তারা কী এই ‘গ্রাম মৃগুপুরে’ ওরা কি বসতি করতে চায়? এমন হলে এত হরিণকে পুর্ণবাসন দেওয়া সমস্যা হয়ে যাবে। এখানে স্থানাভাব প্রচুর। পাণীয় জলের পরিমাণ কম। তাই এদের দেখভাল করতে হলে আরও সরকারি সাহায্যর প্রয়োজন। যে ক’জন হরিণ তাদের সঙ্গে এসেছিল, কোনরকমে একটা করে ঘর খাড়া করে, নক্ষত্র জাতের নারীকে সঙ্গী করে বাস করছে।
এক বয়স্ক হরিণ এগিয়ে এল। সে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “আমরা ভালো নেই, সোমবাবু। তুমি চলে আসার পর থেকেই ভালো নেই।”
সোমের বুকটা ধ্বক করে উঠল। বলল, “কেন?”
“চাঁদের আলো আর আসে না।”
“চাঁদ কি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে?”
“না।”
“সে কি কুষ্ঠ রোগগ্রস্থ?”
“তাও না।”
“তুমি চলে এলে, তোমার পিছু নিল দল দল হরিণ। তারপর চাঁদ ম্লান হতে শুরু করল। প্রথমে আমরা তোমারই মতন ভেবেছিলাম চাঁদ অসুস্থ। পরে দেখা গেল তা নয়। আমাদের থেকে অনেক সরে গেছে চাঁদ। অনেকটা উপরে উঠে গেছে। এতটাই যে আমরা লাফ দিয়েও আর এখানে পৌঁছতে পারব না।”
“তোমরা এখনও নাগরিকত্ব পাওনি?”
“সেটাই সব নয় সোম। নামেই আমরা নাগরিক এখন। কিন্তু কোন সরকারি সুবিধা পাই না। চাকরিতেও যে সংরক্ষণ, সেখানেও আমাদের কোটা নেই। কেবল রেশন পাই—এটাই যা লাভ।”
“এখন তো আর কোন নির্বাচনও নেই!”
“আছে। উপনির্বাচনের পর আসবে গ্রামীণ নির্বাচন। তা এখনও দেরি আছে একটি কল্প। কিন্তু তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সংগঠন বাড়াতে হবে। আমাদের মৃগশিরাকে চাই। শুনেছি সে এক দক্ষ সংগঠক। তার সেই ক্ষমতা আমরা গ্রামীণ নির্বাচনে কাজে লাগাতে চাই। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে হঠাতেই হবে।”
“কিন্তু এমন কোন ঝামেলাতে আমি মৃগুকে ফেলতে চাই না। ও রাজনীতি থেকে বহুদিন দূরে আছে। এখনকার উগ্র রাজনীতি ও বোঝে না। তোমরা চিন্তা কোর না। চাঁদ যে গোলাপি আভার ভেতর দিয়ে আমাদের অতি নিকটেই নেমে এসেছিল, তার সেই দশা শেষ হয়েছে। অচিরেই সে আবার নেমে আসবে।”
“চিন্তা হয় সোম। আমরা আলোর পথের যাত্রী। এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র ভরসা তুমি। কারণ তুমিই পার আমাদের এই সমস্যা থেকে বাঁচাতে। তুমি মৃগশিরাকে ফেরত দাও। সে তো চাঁদের প্রেমিকা। তুমি ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছ, সে খবর চাঁদ পেয়ে গেছে। ও তোমাদের খোঁজার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। আসলে তুমি এমন এক জায়গায় আছ, এত গাছপালা এখানে, পাহাড়ে আলো আটকে যায়, মেঘ করে আসে, গাছের পাতারা নীলবর্ণ; ফলত, সে তোমাদের খুঁজে পায় না। সে আমাদের কাছে শর্ত রেখেছে, যদি মৃগশিরাকে ফিরিয়ে আমরা না নিয়ে আসতে পারি—তা হলে সেই অলৌকিক আলোর পিছনে দৌড় আমাদের বন্ধ হয়ে যাবে।”
সোম চিৎকার করে বলল, “না, তা হয় না। মৃগুকে আমি দেব না। ও আমার। ওকে একদিন ছেড়ে দিতে হবে এই আশাতেই কি আমি এই সমাজ সংসার গড়ে তুলেছি তিলতিল করে? চাঁদ যদি নিভে যায় তো যাক, নক্ষত্রেরা আলো দেবে। কিন্তু আমি কিছুতেই মৃগুকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না।”
“আমাদের জীবনে বৃত্তটাই হল আসল, সোম। বৃত্ত নইলে অস্তিত্বই নেই। আবার সেই বৃত্তকে যদি মূল এর সঙ্গে বিন্দুর সঙ্গে যুক্ত করতে পারি, তাহলেই আমাদের অস্তিত্বের পূর্ণতা। মৃগশিরাকে গিয়ে বল, আমরা এসেছি।”
মৃগশিরা যে কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, তা কেউই বুঝতে পারিনি। তার দিকে চোখ পরতে আমরা সকলেই চুপ করে গেল। সে তাদের পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। সকলে তাকে অনুসরণ করে। আকাশের মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়। এক ফাঁকা মাঠের মধ্যে এসে মৃগশিরা বসে। ধ্যানস্ত ভঙ্গি। সোমের দিকে তাকিয়ে বলে, “সোনা, এবার আমাকে যেতে হবে।”
“যেতে হবে মানে? কোথায় যাবে তুমি? তোমার এটাই ঠিকানা। তুমিই এ গ্রাম সৃষ্টি করেছ। তোমার নামে এখানের শিশুদের নামকরণ হয়। তুমি যখন জানলে আমি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাতে কাজ করতাম, তখন তুমি সেই মত গ্রাম সাজাবার প্রস্তুতি নিলে। তোমার কথা মত সব চলে এখানে। মেয়েরা মধু আনতে গ্রামে যায়, ছেলেরা বনে গিয়ে কাঠ আনে। আমাদের এখানে কারও জীবনে কোন সমস্যা নেই। গাছে গাছে পাখি ডাকে, ভ্রমরা উড়ে বেড়ায়, পশুপাখি আনন্দে বাস করে। আমরা তাদের কখনও হত্যা করি না। তবে তুমি এমন এক মায়াময়, মধুময় জায়গা ছেড়ে তুমি যাবে কোথা?”
“তুমি ক্ষমা কোরো, আমাকে যেতেই হবে—কারণ কালপুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। আর তাই আকাশের অত উঁচুতে উঠে গেছে চাঁদ। বিল্পবী কালপুরুষ যখন আমাদের দেশে গিয়ে আত্মোগোপন করে ছিলেন, এক ভুটিয়া নারীকে তিনি বিবাহ করেন। সেখানে তিনি ভুট্টা চাষ করতেন আর কাঁচা ভুট্টা খেতে খেতে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। তাঁর প্রধান শর্ত ছিল, মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, মানুষের কাজ করতে হবে, মানুষকে ভালবাসতে হবে। গণতন্ত্রে মানুষই সব। তাদের উপর ভর করেই ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে আসতে হবে। মানুষজন ক্ষেপে আছে প্রেসিডেন্টের দুর্নীতির কারণে। কোটি কোটি টাকা নয়ছয়, স্বজনপোষন ইত্যাদি চলছে। এসবের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করেও কিন্তু উপ-নির্বাচনে আমাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। কিন্তু আমরা লড়াই ছাড়ছি না। এবার আমাকে ওদের দরকার। ওদের কোন নেতা নেই। যতদিন না বুদ্ধ এসে দাঁড়ান, আমাকেই সামনে গিয়ে লড়াই দিতে হবে।”
“কিন্তু ওখানে রাজনৈতিক পরিস্থিত এখন ভাল নেই। সেখানে মিড়িয়াকে বেছেবুছে খবর ছাপতে হয়। বিরোধীপক্ষ বলে কেউ নেই। বিরুদ্ধ কারও মুখ খোলার নিয়ম নেই। কবিরা সকলে সমবেত হয়ে রাজাগান গায়। কবে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে কেউ জানে না।”
ভাবলেশহীন মুখে মৃগশিরা বলে যেতে থাকল, “আমাদের জাতের অনেক পুরুষও কালপুরুষের কথা উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামে নেমে আসে। আমাদের নেতার তেমনই নির্দেশ ছিল। গ্রামে গিয়ে কৃষকের মাঝে থেকে কৃষক হয়ে বাস করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে বিবাহ করতে হবে। আমার এখানের কাজ শেষ। তারা যখন ভূমি সংস্কার করবে, নদী বাঁধ দেবে—সেই শিক্ষা কাজে লাগাবে। আর এভাবেই পরিবর্তন আসে।
আমার এখানে কোন অসুবিধা নেই। যা চেয়েছি, সবই পেয়েছি। কিন্তু দেখ, তারপরও অনেকটা বাকি থাকে। এর বাইরের যে জীবন, আমরা সাধারণ হলেও তার টান উপেক্ষা করতে পারি না। আমি এখানে না থাকলেও কিন্তু কিছু অসুবিধা হবে না। চলে যাবে। আমার দায়িত্ব একজনে না পারুক, ভাগাগাগি করে অনেকে কাজ করে চালিয়ে দেবে আমাদের এই গ্রাম। আমাকে এবার ওদিকটা দেখতে হবে। সংগঠন শক্তিশালী না করলে কালপুরুষের স্বপ্ন সফল হতে পারবে না।”
মৃগুর কথা শেষ হতেই এক প্রবল বৃষ্টি ধারা নেমে আসতে থাকে আকাশ থেকে। দেহ টানটান করে মুখ উর্ধে তুলে, চক্ষু নিমিলীত করে সে বসে। চারিধারে ঘিরে ধরে আছে হরিণের দল। সেই দল প্রবল বর্ষণে ভিজে যেতে থাকে। টানটান ঋজুদেহে ক্রমে প্রকট হতে থাকে স্তন, বর্তুল নাভি, কোমর। তার সমস্ত রোমকূপ ভরে উঠতে থাকে জলে। মৃগু চলে গেলে কী এই সব স্থান মুছে যাবে? এই নদী, নীল পাতার গাছ, মেঘ ছায়া, মেদুর সূর্যের রঙ, সব? মাস্টারের কথা মনে পরে সোমের, সেই চন্দ্রালোকের কথা, সেই অপূর্ব জ্যোৎস্নার কথা।
বৃষ্টির বেগ কমে আসতে থাকে। মেঘ যখন পূর্ণ রূপে সরে গেল, এত চাঁদের আলো এল যে, হরিণের দল জয়ধ্বনি করতে লাগল। তারা একে একে ফিরে যেতে থাকল তাদের পথে। মাঠের মধ্যে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বসে পরল সোম। কতদিন পর যে এমন বৃষ্টি হল, তার ঠিক নেই। এতদিন পর এমন রাতের আলো। সব আছে, কেবল মৃগুই নেই! পড়শি হরিণেরা তাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইল। রাজি হল না সোম। সে জানে এই গ্রাম মুছে যাবে। যেমন মুছে গেছে রূপাঞ্জনার গ্রাম।
ভোর হলে সে পা বাড়াল নদীর দিকে। সেখানে ঘাটের ধারে, নৌকা বাঁধা আছে। তাকে এখনি ভেসে পড়তে হবে। এই মনে করে সে ভেলাতে উঠে পড়ল।
কুষ্ঠরোগীর দল কি খুঁজে পেল তাকে?
(ক্রমশ…)
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
পরিচ্ছেদ ৩ শীত শেষ হয়ে আসছে।রাঙ্গালীবাজনা ঢোকার মুখের রাস্তাগুলো পলাশ ফুলে ভরে গেছে।অথচ ঠান্ডাই।…..