তুষার গায়েন । কবি, লেখক।
গত শতাব্দীর শেষ দশকে বাংলা কাব্যজগতে কবি তুষার গায়েনের আত্মপ্রকাশ। এটা এমন এক সন্ধিকাল যখন বাংলা কবিতা বাক ফিরছে নতুন ভাব, ভাষা, আঙ্গিক ও প্রকরণের সন্ধানে ─ আধুনিকতাবাদী কাব্যধারার ক্ষয়িষ্ণু জলস্রোত থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিকোত্তর সৃজন জঙ্গম স্রোতস্বিনী রূপে। কবি তুষার গায়েন এই নতুন কাব্যধারার অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর।
তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য চেতনা-জাগ্রত অনিঃশেষ ভ্রাম্যমানতা যা জীবন ও প্রজ্ঞার সর্ববিধ মাত্রাকে ছুঁয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষায় সর্ব মাধ্যমে বিচরণশীল। গভীরভাবে স্বদেশ ও মৃত্তিকালগ্ন তুষার হাজার বছরের বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত থেকে, ঔপনিবেশিক কালপর্বে খণ্ডিত বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার ও তার বিশুদ্ধিকরণের পাশাপাশি সমকালীন জীবন জিজ্ঞাসা, সংকট ও সম্ভাবনার সাথে একাত্ম হয়ে নিজস্ব ভাষায় কবিতা লিখছেন। ‘ইতিহাস’ যা জনপদের স্মৃতি এবং ‘স্মৃতি’ যা ব্যক্তির ইতিহাস – এই দু’য়ের ভিতর যে সার্বক্ষণিক সংযোগ ও দ্বৈরথ, তার রূপকার তিনি। পাশাপাশি অভিবাসী পৃথিবীর প্রকৃতি, জীবন ও অভিজ্ঞানের আলো এক নতুন মাত্রায়, বাংলা কাব্যে তিনি সংযোজন করে চলেছেন নিরন্তর।
নদীনাব্য দক্ষিণ বাংলা, বরিশালের ভাণ্ডারিয়া শহরে, ৪ জুলাই, ১৯৬৭ সালে তার জন্ম। শৈশব থেকেই বাবার চাকরিসূত্রে ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন শহর ও অঞ্চল যা তার কবিমানস তৈরী করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। মধ্য আশিতে স্নাতক শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান একদা চেতনা সংক্রামক, স্বপ্নরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে। আহত বিস্ময়ে দেখেছেন সাম্যাদর্শে বিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পতন ও নব্বইয়ের দশকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর উপমহাদেশব্যাপী ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তার ও সহিংস সংঘাত যা এখনও বহমান। বর্তমানে কানাডার অভিবাসী নাগরিক হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছেন শীর্ষ পুঁজিবাদী বিশ্ব উত্তর আমেরিকার স্নায়ু অবশ করা ঔজ্জ্বল্য, অর্থনৈতিক মন্দার অভিঘাত এবং বিভিন্ন ভূগোল থেকে আগত অভিবাসী মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পূর্বাপর এইসব কিছু আত্মীকরণের অনিবার্যতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে এবং মাত্রা পেরুচ্ছে তার কবিতা।
একবিংশ, নিসর্গ, বিপ্রতীক সহ দেশের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা ও দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ এবং আলোচনা। সমকালীন বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি এবং ভবিষ্যত রূপরেখা নিয়ে লিখেছেন দীর্ঘ, অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষণঋদ্ধ প্রবন্ধ যা তার সময়ের কাব্যকৃতি অনুধাবনে বিশেষভাবে সহায়ক ও দিক নির্দেশনামূলক। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজী কবিতা সংকলনে তার কবিতা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
তুষার গায়েন ‘দ্য ওডেসা স্টেট একাডেমী অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড আর্কির্টেকচার’ থেকে স্থাপত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন এবং স্থপতি হিসেবে এক যুগেরও অধিক কাল মাতৃভূমি বাংলাদেশে কাজ করেছেন। পরে কানাডায় অভিবাসী হবার পর আমেরিকার ‘দ্য নিউইয়র্ক সিটি কলেজ অব দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি’ থেকে আরবান ডিজাইন-এ মাস্টার্স করেছেন। তার প্রকাশিত কবিতার বই তিনটি: নীলভবহ্রদ (১৯৯৭), বৃষ্টির অন্তর ত্রাস (২০০৩) ও দ্বিমেরুযোজন (২০১২)। কলকাতা থেকে প্রকাশিত অধুনান্তিক বাংলা কবিতার অনুবাদ সংকলন, Postmodern Bangla Poetry 2003 যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন কবি সমীর রায়চৌধুরী এবং কবি কামরুল হাসানের সাথে যেখানে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং বহির্বিশ্বে অবস্থানরত শতাধিক কবিদের কবিতা। প্রবন্ধের বই: বাংলা কবিতা, অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (প্রকাশিতব্য)।