জিম্বাবুয়ের বুলাওয়ে শহরে – ওয়েন মাসেকো ও ইপিলিপি

মঈনুস সুলতান
ভ্রমণ
Bengali
জিম্বাবুয়ের বুলাওয়ে শহরে – ওয়েন মাসেকো ও ইপিলিপি

বেশ অনেকদিন পর আবার বুলাউয়েওতে ফিরে আসলাম। আর্ট গ্যালারির নিচের তলার ক্যাফেতে আজ পুলিশ তালা লাগিয়েছে। তাই মাংকি বারের ঝুল বারান্দায় জাঁকিয়ে বসেছি। এ পানশালায় ঢোকার মুখে বানরের পিতলের মূর্তিটি খোয়া গেছে। বিষয় কি জানতে চাইলে বারটেন্ডার কেইন হুইস্কি পরিবেশন করতে করতে থুতনিতে তার শোঁয়াপোকার মিহি রোয়ার মতো দাড়ি চুলকিয়ে বলেন, বান্দরের ভাস্কর্য সুন্দর দেখে কেউ তা তুলে নেয়নি। দিন-কে-দিন বেড়ে চলছে রাজবন্দীদের সংখ্যা। তাদের ফাটকে পুরতে হলে তো চাই বিস্তর হাতকড়া। এদিকে আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার জন্য বিদেশ থেকে আমদানী করা যাচ্ছে না হ্যান্ডকাপ। তাই লক্যাল দরোগা তা উঠিয়ে থানায় নিয়ে গেছেন কামার দিয়ে গলিয়ে হাতকড়া বানাবেন বলে। আদনা একটি মূর্তি বিলুপ্ত হওয়ার পেছনের কারণ জানতে পেরে আমি থ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি ইক্ষুর নির্যাসে তৈরী কেইন হুইস্কির দিকে। আমি শরাবী নই। পান যে দোষনীয় তাও বুঝতে পারি। তবে জান বাঁচানোর জন্য তা গলধঃকরণ বিধেয় হতে পারে; কারণ বুলাউয়েওতে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না একেবারে।

বুলাউয়েওর আর্ট গ্যালারি (Art Gallary Bulaaweo)

একটু আগে আমি ‘হারারে হেরাল্ড’ পত্রিকায় কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ পাঠ করেছি। ওয়াল্ড হেলথ অরগেনাইজেশনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক জানাচ্ছেন- এক লক্ষাধিক মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার দুঃসংবাদ। এদের মধ্যে ৪,২৮৩ জন আপাততঃ পরলোকগত হয়েছেন। সেলাইন ও ঔষধপত্রের অভাবে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। সুতরাং পানি পান করে আমার যেহেতু জন্নতবাসী হওয়ার কোন খায়েশ নেই, তাই সাতপাঁচ ভেবে হুইস্কিতে চুমুক দেই। অনভ্যাসবশতঃ এ গুরুপাক পানীয় অত্যন্ত কড়া বোধ হয়। জিম্বাবুয়ের হাটেবাজারে নাইফ-ইটার বলে এক ধরনের মানুষ মুখ দিয়ে আস্ত ছুরি-চাকু-ডেগার গিলে দর্শক তামেশগীরদের কাছ থেকে পয়সা নেয়। ভরদুপুরে হুইস্কি পান করে আমার নাইফ-ইটারদের মতো হালত হয়। মনে হয় কেইন হুইস্কি চকচকে চাক্কুর মতো গলা বেয়ে গিয়ে কলিনজায় বিঁধলো।

চিত্রে নির্যাতিত মানুষের স্মৃতি (Maseko painting)

অনেকক্ষণ হয় বেজায় খিদে নিয়ে বসে আছি। মাংকি বারে ঢোকার মুখে গেটে বাজনা বাজিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো আইসক্রিমের ভ্যান। বুলাউয়েওর আইক্রিমের ফেক্টরিতে প্রডাকশন বন্ধ। পাশের দেশ বতসোয়ানার সাথে রবার্ট মুগাবের সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে, সুতরাং ওখান থেকে খাদ্য আমদানী করা অফিসিয়ালি নিসিদ্ধ হয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের ফার্ম জবর দখলের ফলে আজকাল জিম্বাবুয়েতে আলু ফলছে না একেবারে। তাই চোরাগুপ্তা পথে বতসোয়ানা থেকে এখানে আলু আসছে হররোজ। আইসক্রিমের বেকার হওয়া ভ্যানটি একটু আগে এখানে খালাস করে গেছে ছালা ভতি রুসেট পটেটো। কেইন হুইস্কির পাত্রে গুনাগারী করতে করতে আমি ইন্তেজারী করি কখন ইললিগ্যাল আলু রূপান্তরিত হবে ক্রিস্প ফ্রেন্স ফ্রাইতে।

রক্তঝরা চিত্রের সামনে শিল্পী (Owen Maseko Painting)

আগের বার যখন আমি বুলাউয়েওতে কাজ করতে আসি, তখন জাতীসংঘের হিসাবানুযায়ী তামাম দেশের বারো মিলিওন মানুষের অর্ধেক প্রায় ছয় মিলিওন আদম সন্তান শিকার হয়েছিলো প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের। ইতিমধ্যে পরিস্থিতির বদল হয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের ফার্মগুলো করতলগত হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ সরকারী জানুপিএফ পার্টি সমর্থিত ওয়ার ভেটারানদের – যারা চেমুরেঙ্গা বলে পরিচিত মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছিল। এদের অনেকেই রাজনৈতিক এলিট, চাষবাসের তেমন কিছ জানেও না, সুতরাং দেশের খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে বিপদজ্জনক মাত্রায়। এতে দুই মিলিওন কৃষ্ণাঙ্গ ফার্ম ওয়ার্কার চাকুরীচ্যুত হয়ে বাড়িয়েছে অনাহারী মানুষদের সংখ্যা। এদের দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত জীবনযাপনের গর্দিশ নিয়ে যে জিম্বাবুয়ান সাংবাদিক তার লেখনীর মাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন সবচেয়ে বেশী- তাঁকে খুন করা হয়েছে। তার ষাটটি আলোকচিত্র নিয়ে ‘জিমরাইটস্’ বলে একটি সংস্থা প্রদর্শনী করছিলো, পুলিশ ওখানে এসে ছবিগুলো ক্যামেরা সহ হুকুম-দখল করেছে। সুতরাং, এখন পরিস্থিতি কি-তা নিয়ে তেমন কিছু অথেনটিকভাবে আঁচ করা যাচ্ছে না।

এ হালতেও আমার কপাল ফিরেছে, গোপাল আমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন। সাউথ আফ্রিকার একটি একাডেমিক জার্ণালে আমার জিম্বাবুয়ে নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ অঞ্চলের যে একাডেমিক সার্কেলে আমি ঘুরপাক খাই, তার তুকতাক হচ্ছে পাবলিকেশনস্। আমি কখনো সখনো নিজেকে লেখক হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকি। লেখা প্রকাশিত না হলে আমার জাত থাকে না, লোকজন চালিয়াত ভাবে। পুরা লেখাটি আমার নামে যাবে না বটে, মূল অথর হবেন জাসটিনা মুকোকো বলে একজন হিউম্যন রাইটস্ এক্টিভিস্ট। কো-অথর হিসাবে আমি অপদার্থ হলেও তিনি প্রকাশনা রথের পার্থ বিশেষ। তাকে উছিলা করে আমি জার্নালের পুলসেরাত পাড়ি দেবো। ‘সুইডিশ এনজিও ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যান রাইটস্’ বলে একটি দাতা সংস্থা এ প্রবন্ধের ডাটা কলেকশনে টাকা ঢালছে। তাদের ভাতা পারডিয়াম নিয়ে আমি আবার হাজির হয়েছি বুলাউয়েওতে মাঠ পর্যায়ে উপাত্ত সংগ্রহ করতে।

বুলাউয়েও হচ্ছে জিম্বাবুয়ের মাটাবিলিল্যান্ড অঞ্চলের প্রধান শহর। এদিকে নেডেবেলে সম্প্রদায়ের বাস। ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে এরা সংখ্যাগরিষ্ট মাসোওনা বা সংক্ষেপে সোওনা গোত্রদের থেকে ভিন্ন। অন্য বৃহৎ রিজিওন হচ্ছে মাসোওনাল্যান্ড যেখানে মাসোওনাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সরকারী দল জানুপিএফ এবং দেশের বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে সকলেই মোটমির্যা মাসোওনা সংস্কৃতির প্রতিনিধি। আমি যে প্রবন্ধের জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করছি তার ব্যাকগ্রাউন্ড হবে মাটাবেলিল্যান্ডের নেডেবেলে সম্প্রদায়। চেমুরেঙ্গা বা শ্বেতাঙ্গ শাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়ের পর এ অঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক সংঘর্ষ ‘গুকুরাহুনডি’ বা সিভিল ওয়ার বলে পরিচিত। এ চিসোওনা টার্মটির বাংলা তর্জমা হতে পারে-বৃষ্টিপাত যা ধুয়েমুছে সাফ করে সমস্ত আবর্জনা। চেমুরেঙ্গা খতম হলে পর মাসোওনা ও নেডেবেলে সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক দ্বন্ধ সশস্ত্র আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যা গরিষ্ট মাসোওনা সম্প্রদায়ের নেতা রবার্ট মুগাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে সংখ্যালগিষ্ট নেডেবেলে জনগোষ্ঠি জোসোয়া নোকোমর নেতৃত্বে সায়ত্ত্ব শাসনের দাবী তোলে। দুই সম্প্রদায়ের সশস্ত্র বিরোধ তীব্র হতে থাকে।

চিত্রশিল্পী ওয়েন মাসেকো (Owenmaseko)

এ বিষয়টি জটিল। আমাকে তা লিখতে হবে দুই প্যারাগ্রাফে। সুতরাং, আমি নোটবুকে গুকুরাহুনডি’র মূল ঘটনাগুলোকে কয়েকটি চুম্বক বাক্যে নিয়ে আসি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ক্ষমতা সংহত করতে রবার্ট মুগাবে নিজেকে নিয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে। তারপর তৈরী করেন নর্থ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ফিফথ্ ব্রিগেড। এরা মাটাবিলিল্যান্ডে পাইকারি হারে গণহত্যা চালায়। রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদী নেডেবেলেদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে মাসোওনা সংস্কৃতির প্রশংসা করে শ্লোগান দিতে ও গান গাইতে বাধ্য করা হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রানুযায়ী ২০ হাজারের উপর নেডেবেলে মানুষের মৃত্যু হয় গুকুরাহুনডি’র পলিটিক্যাল তুলতবিলে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক ভিকটিমদের লাশ ট্রাকে করে বয়ে নিয়ে ফেলে দেয়া হয় পরিত্যক্ত খনির গহ্বরে। গুকুরাহুনডি’র রক্তাক্ত বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে ফিফথ্ ব্রিগেড ধুয়েমুছে সাফ করে ভিন্ন সংস্কৃতি ও মতাদর্শের আর্বজনা।

চিত্রের সামনে দর্শক (Painting Owen Maseko)

নোটবুকে তথ্য সংক্ষিপ্তকরণ দ্রুত আগায়, তবে বর্ণনাতে আসে না ডেপথ্, কিংবা ভিন্ন জনগোষ্ঠির ওপর জুলুমজনিত যন্ত্রণা। কিন্তু উপায় কি? পাবলিকেশন ছাড়া লেখক হচ্ছে ভার্জিন রূপজীবীর মতো। অন্তত একটি প্রবন্ধের সাথে স্বনাম যুক্ত করতে পারলে বিষয়টি হবে প্রথম খদ্দের ধরা বা নথ খোলার মতো গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, আমাকে লিখতে হয়। কেইন হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে চেষ্টা করি যে সব উপাত্ত ইতিমধ্যে সংগ্রহ করেছি তার ভেতর মশগুল হতে।

টেবিলে নখ দিয়ে খুটখুটিয়ে,‘হেই ম্যান লুক এ্যট মি?’ আওয়াজ হলে নোটবুক থেকে চোখ তুলে দেখি চেয়ার টেনে বসছে ইপিলিপি মোফুফা। সে পরে আছে লেপার্ড স্কিন প্রিন্টের মিনি স্কার্ট। নাভির উপর গিঁট দেয়া তার টপ। মেয়েটির বেশভূষার এ পরিবর্তন আমাকে তাজ্জব করলে সে যেন জলন্ত অংগার ঘঁষা লিপস্টিকে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে অনুযোগ করে- ‘আই অ্যাম হ্যাংগ্রি এন্ড থাসটি ম্যান।’ বারটেন্ডারকে কিছু বলতে হয় না, সে আরেক পাত্র কেইন হুইস্কির সাথে নিয়ে আসে আলু দিয়ে ক্রিস্প করে ভাজা দু’প্লেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। গতকাল আমি আর্ট গ্যালারির নিচের তলার ক্যাফেতে বসে ইপিলিপির সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমার সংগৃহিত উপাত্তে সামিল হয়েছে তার জীবনের বর্ণনা। কাল সে পরেছিলো মাথায় কাপড়ের হেড-গিয়ার বাঁধা খুবই সাদামাটা নেডেবেলে মেয়েদের পোষাক। সব প্রশ্নের জবাব সে দেয়নি, তবে খুব সিগ্ধ করে বারবার হাসে; তাতে মনে হচ্ছিলো, তার মরদ যেন সারাদিন খনিতে মেহনত করে ফিরে এসেছে পাথরের হার নিয়ে। বারটেন্ডার দাঁড়িয়ে আছে। খাবার ও পানীয়ের দাম ক্যাশে পরিশোধ করতে হয়। আমি সাউথ আফ্রিকান কারেন্সি রেন্ড এর নোট দিলে বক যে রকম গ্রীবা না নাড়িয়ে জলতলে মাছের চলাচল লক্ষ্য করে- সেরকম ইপিলিপি নিঃশব্দে টাকার লেনদেন নজর করে।

খদ্দের ধরে চিত্র বেঁচার ব্যপারে ইপিলিপির যতোটা সুনাম তার চেয়ে বেশী দুর্নাম নিরাবরণ মডেল হিসাবে আর্টিস্টদের এক্সপ্লয়েট করা নিয়ে। আর্ট গ্যালারির ক্যাফেতে সে বসেছিলো একটি ছবি হাতে নিয়ে। অজানা এক চিত্রকরের আঁকা ফিস ঈগলের বর্ণাঢ্য ছবিটির দিকে এমনভাবে সে তাকিয়ে ছিলো যেন পাখিটির মুখে এখনই ফুটবে প্রথম বুলি। আর্টপিসটি সে বিক্রি করতে চেয়েছিলো। আমি তা খরিদ করতে তৎক্ষণাত রাজি হইনি, তবে টেবিলে বসে সঙ্গ দেয়ার জন্য সাউথ আফ্রিকার কারেন্সি দিয়ে হিসাব করে এক ঘন্টার মজুরি দিয়েছিলাম। সে ভাজা ইয়ামের সাথে এনামেলের মগে কড়া ধাচের ডিসস্টিলড্ কাসাসু পান করে এলোমেলো বাচনভঙ্গিতে জড়িয়ে জড়িয়ে কিছু তথ্য দিয়েছিলো। গুকুরাহুনডি’র সময় সে ছিলো ছোট্ট এক শিশু। তার পিতা নিখোঁজ হলে তার মা তাকে নিয়ে সশস্ত্র সৈনিকদের ক্যাম্প, পুলিশ স্টেশন ইত্যাদিতে সুলুক সন্ধান করতে যেতো। একটি ক্যাম্পে তার মা’কে আটকে রেখে সৈনিকরা তাকে জিপে চড়িয়ে বেশ দূর নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে আসে। ফিফথ্ ব্রিগেডের অফিসারের বাসায় শিশুশ্রমিক হিসাবে কাজ করার সময় নিগৃহিত হওয়ার কথাও তার আবছা আবছা মনে পড়ে। হারারে শহরে এক এইডস আক্রান্ত মারকুটে লোকের কাছে সে বিক্রি হয়- যখন তার বয়স বারো কিংবা তেরো। মানুষটি কিন্তু খারাপ ছিলো না। তার কৌমার্যের বিনিময়ে সে তাকে কিনে দেয় ফেন্সি জামা-জুতা-কসমেটিক, প্রচুর খাবার দাবার ও পানীয়। তার ধারনা ছিলো কুমারী সম্ভোগের মাধ্যমে সে রোগমুক্ত হবে দ্রুত। কিন্তু মাস কয়েকের মাথায় সামান্য জ্বরে তার মৃত্যু হয়।

কথা বলতে বলতে ইপিলিপির চোখ ঘোর হয়ে আসে। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে সে মাটাবিলিল্যান্ডের তাসোলোতসো এলাকার কথা বলে- যেখানকার পাথুরে পাহাড়ের কাছে ছিলো তার বাপ-মায়ের কুটির। খুঁজে খুঁজে ওখানে সে ফিরেও গিয়েছিলো একদিন। না, ঘরদুয়ার কিছু আর নেই। সব কিছু ঢেকে আছে ঘন ঝোপঝাড়ে। তবে ছোটবেলার মুকওয়া গাছটি আগের মতোই আছে। তার গোড়ায় খোড়লে বাস করতো এক কচ্ছপ। সে মাঝে মাঝে তাকে সবজি ও আনাজপত্র খাওয়াতো। কি আশ্চর্য? প্রৌঢ় কাছিমটি আগের মতোই আছে। ইপিলিপির সাড়া পেয়ে সে গর্ত থেকে বেরিয়ে গলা বাড়িয়ে খাবার চায়। আমি জানতে চাই তার পরের ঘটনা। ছবি আঁকার সার্কেলে সে সামিল হলো কিভাবে? আর মডেল হয়ে উঠার সুযোগ আসলো কখন? ইপিলিপি ততক্ষণে আস্ত আরেক মগ কাসাসু পান করে খুব মিষ্টি করে হাসছে। আর বিশেষ কিছু বলতে চায় না সে।

মাংকি বারে ওয়েন মাসেকোকে দেখে আমি তাজ্জব হই না একেবারে। তাকেও আমি কালকে এক ঘন্টার পারিশ্রমিক অগ্রিম দিয়েছি । প্রত্যাশা তিনি নিজের সম্পর্কে একটু কথাবার্তা বললে আমি পেয়ে যাবো জরুরি কিছু উপাত্ত। গতকাল তার সময় হয়নি । সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে তিনি ব্যস্থ ছিলেন আর্ট গ্যালারির দেয়ালে গুকুরাহুনডি বা সিভিল ওয়ারেরর ওপর তার আঁকা চিত্রগুলো টাঙ্গাতে। ওয়েন মাসেকো ইপিলিপির টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার খোলা কাঁধ টিপে দিতে দিতে খিকখিক করে হেসে,‘আই সি, মাই লাভলি গার্ল ইজ ইটিং পটোটো’, বলে তার প্লেট থেকে দুটি ফ্রেঞ্চফ্রাই তুলে নিতে চাইলে সে দু’হাত থাবার মতো তুলে চিতাবাঘিনী যেভাবে শিকার প্রটেক্ট করে, সেরকম তার আলু ভাঁজা রক্ষা করে। ওয়েন অগ্যতা আমার টেবিলের দিকে তাকালে আমি ‘সাওবোনা মানতফোয়ানামি’ বলে সম্ভাষন জানিয়ে বলি, ‘বাবা মাসেকো, জয়েন মি ফর সাম ফ্রাইড পটোটো এন্ড এ গ্লাস অব কেইন হুইস্কি।’ ফেঞ্চ ফ্রাই খেতে খেতে তিনি বলেন,‘আই রিয়েলি নিড এ বাইট। গতরাত থেকে গ্যালারিতে কাজ করছি। ওদিকে খাওয়ার কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছিলো না।’

গুকুরাহুনডি’র উপর তার আঁকা চিত্রগুলোর একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিতে আমি তাকে অনুরোধ করলে তিনি ঘুরে ইপিলিপির দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে শিস দেন। তাতে কোন রেসপন্স না আসলে তিনি একটু সময় নীরবে কি যেন ভাবেন। দীর্ঘ দড়িবলা জটপাকানো চুলে নেডেবেলে এ চিত্রকরকে মনে হয় বজ্রপাতে পোড়া কালো কোন গাছ কুঁদে বানানো উডকাটের মূর্তি। ‘না, গুকুরাহুনডির সময় কী ঘটেছিলো তা আমি দেখেছি বললে মিথ্যা বলা হবে। আমার বয়স ছিলো খুব কম। ছবিগুলো আমি এঁকেছি যারা ফিফথ্ ব্রিগেডের হাতে তাদের খেশকুটুমের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদের সাথে কথা বলে।’ এ পর্যন্ত বলে ওয়েন থেমে তার গলায় ঝুলে থাকা অত্যন্ত বড়সড় চাবি দিয়ে চুলের জট চুলকান। তারপর এক ঢোঁকে কেইন হুইস্কির গ্লাস খালি করে বলেন,‘ ফিফথ্ ব্রিগেড আমার বাবাকে মার্ডার করে। আত্মীয় স্বজনরা পরিত্যক্ত তামার খনি থেকে তার লাশ তুলে নিয়ে এসেছিলো। সাদা শার্টের সাথে কালো স্যুট পরে ছিলেন তিনি। রক্তক্ষরণে শার্টের রঙ পাল্টে হয়ে গিয়েছিলো সম্পূর্ণ লোহিত, আর বোতামগুলো ছিড়ে গিয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে তাকে সমাহিত করতে হয়। কবরে নামানোর আগে মা তার মুখের রক্ত মুছে দিয়ে সুইসুতা দিয়ে বোতামগুলো লাগিয়ে দেয়।’

ইপিলিপিলি এবার আমাদের টেবিলে এসে বসলে আমরা তার দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে যাই। একটুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ওয়েন আস্তে ধীরে আবার কথা বলেন। ‘গুকুরাহুনডির উপর চিত্র প্রদর্শনীর আমরা ফর্মাল কোন এনাউন্সমেন্ট করিনি। শুধু ওয়ার্ড অব মাউথ। সকাল থেকে দর্শকরা আসছে। কামঅন অভার এ্যট দ্যা আর্ট গ্যালারি ম্যান’, বলে ইপিলিপিকে নিয়ে ওয়েন উঠতে গেলে, ‘ইন দিস টাফ টাইম ওয়েন, হোয়াই আর ইউ টেকিং দিস রিস্ক?’ বলে আমি তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেই। চাবি দিয়ে জট চুলকাতে চুলকাতে তিনি বলেন,‘লিসেন, হোয়াইট ফার্মারদের উৎখাত নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছে। পাশ্চাত্তের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও রেইসিস্ট, বর্ণবাদী তারা। নেডেবেলেরা আফ্রিকান ব্ল্যাক, সুতরাং ২০ হাজার কালো নেডেবেলের মৃত্যু নিয়ে ওয়েস্টার্ন মিডিয়া উচ্চবাচ্চ্য করেনি। আই উইল নট এলাও দি ওয়ার্ল্ড টু ফরগেট দিস। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মি ম্যান।’ আমি এবার তার বাড়িয়ে দেয়া হাত চেপে ধরে বলি,‘অলরাইট বাবা, ইউ টুক রিস্ক, নাউ হাউ আর ইউ ডুয়িং?’ ইপিলিপির খোলা কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতে তিনি বলেন,‘আই ফিল লাইক এ রেসিং হর্স। আমার পায়ের নিচে কোন ট্রাক নেই, নেই রেস কোর্সের ময়দান। তারপরও আমি একটার পর একটা হার্ডোল, প্রচন্ড সব প্রতিবন্ধক অতিক্রম করে ছুটছি। সি ইউ এ্যট দি আর্ট গ্যালারি ম্যান।’

আর্ট গ্যালারিতে ওয়েন মাশেকোর ‘গুকুরাহুনডি’র ওপর যে চিত্র প্রদর্শনী চলছে তার শিরোনাম ‘সিবানটিসেলে’। ভাটি থেবে বলে গ্যালারির প্রৌঢ় ম্যানেজার তামাক পাতা প্যাচিয়ে সিগ্রেট রোল করতে করতে আমার জন্য সিবানটিসেলে লবজটির ইংরেজী করেন,‘লেটস ড্রিপ অন দেম।’ তার চোখেমুখে এমন এক ধরনের উদ্বেগ খেলা করছে যে মনে হয়, একটু আগে তার কন্যার কিডন্যাপ হওয়ার সংবাদ এসেছে, কিন্তু তিনি তার প্রাণনাশের আশংকায় এ বিষয়ে কারো সাথে আলাপ করতে পারছেন না। খোদ চিত্রশিল্পী ওয়েন দাঁড়িয়ে আছেন তার লোহিত বর্ণের বিশাল পেইনটিংয়ের সামনে। তাকে রেসের টগবগে ঘোড়ার মতো দেখায়, মনে হয় অপেক্ষা করছেন বন্ধুকের আওয়াজের; গুলি হলেই লোহার নালে ধুলা উড়িয়ে ছুটবেন। মোট বারোটি বড় মাপের পেইনটিং, কিছু রাজনৈতিক গ্রাফিটি ও ত্রিমাত্রিক তিনটি ইনসটোলেশন মিলিয়ে তাবৎ শিল্পকর্ম যেন দর্শকের সাদা দিলে লেপে দিচ্ছে খুন হওয়া মানুষদের তাজা রক্ত।

তীব্র টেনশন সারা আর্ট গ্যালারিতে বুনে দিয়েছে আশংকার মস্ত মাকড়শার জাল। ড্রামের বাদ্য বাজে। তাতে জালে আটকানো পাখির পাখা ঝাপটানোর মৃদু আওয়াজ হয়।

কোন হাঁকডাক না করে নিঃশব্দে গ্যালারিতে ঢুকে পড়ে পুলিশ । জনা কয়েক কনস্টেবোল পেইনটিংসগুলো নামাতে শুরু করে। দেয়ালে ফ্রেস্কো অংকনরতবস্থায় রঙ ভেজা ব্রাশ হাতে একজন অফিসারের সাথে ওয়েন মাশেকো নেমে যান নিচে। আমি গ্যালারির প্রশস্ত বেলকনিতে এসে নিচের দিকে তাকাই। ওয়েনের সাথে আরো কয়েকজনকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। গ্যালারিতে আবার ফিরে আসলে দেখি, গ্যালারির ম্যানেজার ভাটি থেবে ঘেমে নেয়ে ওঠে তামাক প্যাচানো সিগ্রেট মুছড়ে দারোগার সাথে কন্সটিটিউশনের ফ্রিডম ফর ক্রিয়েটিভ আর্টের ধারা নিয়ে তর্ক জুড়েছেন। দারোগা আস্তে ধীরে আফ্রিকানার বুয়ারদের খটমটে ভাষায় ভাটি থেবেকে ‘ভয়েট সাক’ বলে হাঁকিয়ে দেন। লবজটি আমি বুঝতে না পারলে- ভাটি থেবে ফিসফিস করে আমাকে বলেন দারোগা তাকে ‘পুলিশি বিষয় নিয়ে সঙ্গম না করতে বলেছেন।’  দারোগা আমার দিকে তাকালে আমি জানতে চাই-দর্শক হিসাবে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা বেআইনি কিনা। তিনি গুড়ুৎ করে ঢেঁকুর তুলে আমাকে বলেন,‘ফাক অফ’, যদিও এক্ষেত্রে শাটআপ বললেই দিব্যি কাজ চলতো।

সন্ধ্যাবেলা বিবিসি’র আফ্রিকা সার্ভিস শুনি। ওয়েন মাশেকো হাজতেই আছেন। পুলিশ ভাটি থেবে’কেও পাকড়েছে। তাদের জামিন দেয়া হয়নি। প্রতিবেদক জানাচ্ছেন-পাবলিক অর্ডার এন্ড সিকিউরিটি এক্টে ওয়েনের কারাগারে কুড়ি বছরের সাজা হতে পারে।

মঈনুস সুলতানের জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে। খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস্ এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কন্সালটেন্ট...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..