বক্রপুচ্ছ

অনুশ্রী তরফদার
ছোটগল্প
Bengali
বক্রপুচ্ছ

 

চোখ খুলতেই হাসপাতালের বেডে নিজেকে দেখতে পেয়ে চমকে গেল খগেশ্বর পাল ওরফে খচড়াদা। ব‍্যাথার জন‍্য কাল রাতে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। ঘোর কাটছে। এতবড়ো ধাক্কা খাবে যে তা মাথাতেও আসেনি। মাথাটায় বেশ বড়ো পট্টি বাঁধা, আটটা সেলাই পড়েছে। ক্লাবের ছেলেরাই ভর্তি করে বাড়িতে খবর দিয়েছে। ভয়ের কিছু নেই, এক্সরে হয়েছে, আরও কিছু টেষ্ট ফেষ্টও হয়েছে। পাঁচদিন পরে সেলাই কাটতে হবে। আপাতত কদিন বিশ্রাম। মুখটা কদিন বন্ধ থাকবে এটা ভেবেই স্বস্তি। মুখ খুললেই তো মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

যে কোনো বিষয়ে একটা নেগেটিভ কমেন্ট না করলে খচড়ার ভাত হজম হয়না। কাজকর্ম তো কিছুই নেই, বাপের সম্পত্তির একমাত্র অংশীদার। বাজারে ছয়টা দোকানের ভাড়া আর চারটে বাড়িভাড়া সব মিলিয়ে মাসে প্রায় লাখেরও বেশি আয় হয়। সেই আমলে লোকসংখ‍্যা কম ও জমির দাম কম থাকায় খচড়ার বাবা বাজারে সস্তায় কটা দোকান নিয়েছিল। এখন সেগুলোই সোনার ডিম পাড়া হাঁস। আর বাড়ির পাশের চারকাটা ফাঁকা জমি জলের দামে পেয়েছিল। সেখানে দোতলা করে নীচে দুটো উপরে দুটো মোট চারটে পরিবারকে ভাড়া দেওয়ার ব‍্যবস্থা করেছে। বাবা এখন নেই, তাই সব মালিকানা খচড়াদার। কোনরকমে মাধ‍্যমিক পাশ করে পড়াশোনায় ইতি। সারাদিন ফিটফাট বাবু হয়ে ঘুরে বেড়ানো আর যেচে পড়ে লোকের কথার মাঝে ঢুকে খোঁচা মারাই তার কাজ। বিয়ে হলো, ছেলেমেয়েরা বড়ো হচ্ছে কিন্তু খচড়ার খচড়ামি চলছেই।

উল্টোদিকের বাড়ির সৈকত উচ্চমাধ‍্যমিকে জেলায় যৌথভাবে তৃতীয় হয়েছে, বাড়িতে বেশ আনন্দ উৎসব। পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন আসছে যাচ্ছে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, মিষ্টিমুখ। সাংবাদিকরা এসেছে, সাক্ষাৎকার নিচ্ছে সৈকতের ও বাড়ির লোকের। সাথে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরও। হঠাৎ খচড়াদা আগ বাড়িয়ে বলে বসলো-
এ আর কি এমন রেজাল্ট, আর কিছু নম্বর পেয়ে একা জেলায় প্রথম হয়ে দেখাত তাহলে মানা যেত। উপস্থিত সবার মুখ থ, মাঝখানে বিল্টু বলে ওঠে-
তোমার কতো ছিল গো নম্বর? সামনের বছর তো তোমার ছেলেও দেবে পরীক্ষা, তখন সাক্ষাৎকার দিও।
রেগে বকবক করতে করতে বিল্টুকে যা মুখে আসল বলে সেখান থেকে বিদায় নিল খচড়া। এই স্বভাবের জন‍্যই সবাই ওকে খচড়া বলে ডাকে।

মোড়ের মাথার দোকানে সন্ধ‍্যাবেলায় বসে চা খাচ্ছে পাড়ার কয়জন আর দেশ দুনিয়ার গল্প চলছে।
স্বপন বলে ওঠে – কি রে পলাশ কাল নতুন টিভি এনেছিস? কতো নিল ভাই, কিস্তিতে নিলি?
হ‍্যাঁ গো স্বপনদা, চারহাজার দিয়েছি আর প্রতি মাসে একহাজার করে দিলেই বছর খানেকের মধ‍্যে শোধ হয়ে যাবে।
বাহ্ ভালো করেছিস।
পুটুস করে লাল পিঁপড়ার কামড় মারে খচড়া। বলে বসে- এ বাবা মাত্র ষোলোহাজারের টিভি কিনেছিস, তাতেই একবছর ধরে পয়সা দিবি। এতো একবারেই কেনা যেত। সবাই চুপ!
পলাশ বলে সে তো কিনতেই পারতাম যদি বাবার অঢেল সম্পত্তি থাকত। পড়াশোনা করে ছোটখাটো একটা চাকরি করি। মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। এটাই অনেক ভেবেচিন্তে করতে হলো।
দ‍েখ্ পলাশ বাবার সম্পত্তি তুলে খোঁচা মারিসনা। সম্পত্তি থাকলেই হয়না, তা দেখেশুনে রাখাটাও কাজ।
তুমি তাহলে কাওকে তার সামর্থ্য নিয়ে খোঁচা দিতে এসোনা খগাদা। ইট ছুঁড়লে পাটকেল খেতেই হবে।

সকাল সকাল ব‍্যাগ হাতে বাজারের দিকে চলছে খচড়া আশেপাশের পরিস্থিতির দিকে চোখকান স্বজাগ রেখে। সকাল থেকে একটাও খোঁচাখুঁচি হয়নি। বিমলদা বাড়ির গেটের সামনে থেকে দরাদরি করে মাছ কিনছেন। যথারীতি খচড়ার বাণী শুরু।
কি বিমলদা কি মাছ কিনছেন?
ইলিশ।
কত করে? মাপ কি?
হাজার টাকা কেজি, ঐ এক কেজি, নশো এমন সব ওজনের হবে।
এইটা কোনো ইলিশের মাপ হলো! আরে আমি তো কাল পনেরোশো টাকা কেজি দরে এক, দেড়কেজি ওজনের ইলিশ কিনেছি। কি দারুণ! একেবার পদ্মার ইলিশ যাকে বলে।
ওহ! তা ভাই এরপর থেকে যখন কিনবে সবার বাড়ি এককেজি করে দিয়ে যেও। আমরা ভূতের বাপ! শ্রাদ্ধটা তোমার বাপের খরচেই হোক।
মাছ খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বলুন, একপিস্ দিয়ে যাব। এইভাবে কথা শোনাবেন? উহুহুহুহু! ভুল করছ খগা। মাছ খাই বলেইতো কিনি। আমার যা সাধ‍্য ও সাধ সেটা মাথায় রেখে। তুমি বাপু বোঝোনা এই সাধারণ ব‍্যাপারটা। এখন এসো, আমার আবার কাজ আছে অনেক। ফালতু কথা বলার সময় নেই।
মুখ ভার করে ফুঁসতে ফুঁসতে খচড়ার প্রস্থান ঘটে।

সেইবার তো এক ধুন্ধুমার কান্ড। মাসতুতো শালার মেয়ের বিয়ে। পাশের পাড়াতেই। তো খচড়া তার পরিবার নিয়ে সকাল থেকে হাজির। চারিদিকে ঘুরে তদারকি করছে, হম্বিতম্বি করছে বাড়ির জামাই বলে কথা। আত্মীয়স্বজনরা খচড়ার কীর্তিকলাপের সাথে অভ‍্যস্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বিরক্তিকর পরিস্থিতি হলেও তারা মানিয়ে নেয়। ঝামেলা শুরু হলো সন্ধ‍্যাবেলা বর আসার পর। খচড়াকে আপ‍্যায়নের দায়িত্ব না দেয়া হলেও নিজের থেকেই সে হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে। বর আসার পরে বরণ করে নামিয়ে তাদের জন‍্য সজ্জিত জায়গায় বসানো হলো। চা সরবত টিফিনের ব‍্যবস্থা হয়েছে। পাত্র পেশায় সফ্টওয়‍্যার ইঞ্জিনিয়ার। টিসিএসে কর্মরত। একমাত্র ছেলে। বরযাত্রী ছাড়াও বিয়েবাড়ির অনেক লোকও সেখানে উপস্থিত। হঠাৎ খচড়া বলে ওঠে-

যা শুনেছিলাম তা নয়, ছেলে তো দেখছি বেশ খাটো, গায়ের রঙও ভালোই কালো। এ আর এমন কি পাত্র! আমাদের পিউয়ের সাথে একদম মানাবেনা।
যেইনা বলা সেই কথা চারিদিক থেকে হইহই বেঁধে যায়। পাত্র বলে ওঠে-
বাবা এই অসভ‍্য লোকটা কে? ওনাকে এতোবড়ো কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে? মোটামুটি ঝামেলা বেঁধে যায়। খবর যায় বাড়ির ভেতরে। খচড়ার শালা- সম্বন্ধি সব ছুটে আসে। সব শুনে ছেলের বাবার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চায় কনের বাবা, জ‍্যাঠা। ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে। খচড়াকে তার বৌ এসে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। সেই যে রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে খচড়া ও তার পরিবার বাড়ি ফিরে আসে তারপর থেকে দুবছর হলো মাসিশাশুড়ির বাড়ি যাওয়া বন্ধ।

খচড়ার বাড়ির এক ভাড়াটের ঘরে ভাদ্র মাসের বারের পূজা ও নারায়ন পূজা। পাড়ার মোটামুটি সবাই নিমন্ত্রিত। খচড়া তো থাকবেই জানা কথা। পূজা শেষ হলে প্রসাদ ও খিচুড়ির পর্ব এলো। সবাই খাচ্ছে বেশ তৃপ্তি করেই। খচড়াও খেতে বসেছে। খেতে খেতেই সবার মাঝে বিশেষজ্ঞ মন্তব্য শুরু –
সিন্নিটা ভীষণ পাতলা হয়েছে, দুধ কম জলের পরিমাণ বেশি। এ কেমন সিন্নি? এরমধ‍্যে কেজিখানেক খোয়া আর নারকেল বেশি করে দিতে হতো। নাহ্ খিচুড়িটাও কেমন দলাদলা, সাবু মেরেছে নিশ্চয়ই। এইভাবে পূজা করলে কি আর মনস্কামনা পূর্ণ হয়!
চুপচাপ শুনছিল সবাই। হঠাৎ সরকার মাসিমা বলে ওঠেন-
ও খগা সামনের সপ্তাহে তোমার বাড়িতে একটা পূজার আয়োজন করো দেখি বাপু, আর মনের মতো করে সবাইকে খাইয়ো। এখন আমাদের শান্তিতে প্রসাদ নিতে দাও।
আম্ আম্ আমার বাড়িতে?
আম আম করছ কেন খগা? হ‍্যাঁ তোমার বাড়িতে। তোমার বাবা-মা গত হওয়ার পরে তো কোনদিন কোনো পূজাপাঠ করতে দেখলাম না।
খগা পড়ল বিপদে, একে বারঠাকুরের পূজা তাও সবার সামনে মাসিমা বলে ফেললেন। পাপপূণ‍্যের ভয় তো আছেই। অগত‍্যা খগাকে রাজি হতে হলো পূজার জন‍্য। খগার বৌ পাশে বসে বিড়বিড় করতে লাগল-
নাও, ঠ‍্যালা সামলাও এবার। সবসময় বাজে বকবক না করলে শান্তি হয়না না! তোমার জন‍্য বাড়ির বাইরে মন খুলে কথাও বলতে পারিনা। তোমার মতো লোক যেন কোনো শত্রুর কপালেও না জোটে।

দুদিন একটু জলের মতো সহজ থাকে, তিনদিনের মাথা থেকে খগা আপ্রতিরোধ‍্য গতিতে নিজের ছলাকলা ঘটাতেই থাকে। কখনও কার বাচ্চা কোন স্কুলে ভর্তি হলো, সেই স্কুল কতটা ভালো বা খারাপ, কোন বাচ্চা দেখতে ভালো বা খারাপ, কার বাড়ির রঙ ভালো হয়নি এইসব বিষয়ে কাটাছেঁড়া চলতেই থাকলো খচড়াদার।

সেদিন দুপুরে হইহই পড়ে গেল পাড়ায়, ক্লাবের ছেলেরা উর্ধ্বশ্বাসে বাইক নিয়ে ছুটল। সব বাড়ির মানুষ বেড়িয়ে এসেছে রাস্তায়। সবার মুখে মুখে একই কথা-
এতো বড়ো আ‍্যক্সিডেন্ট হয়েছে গৌতমের, ছেলেটা বাঁচবে তো! গৌতমের মা একটু একটু পরপর জ্ঞান হারাচ্ছে, ওদের বাড়িতে কিছু মানুষ সামলাচ্ছে ওর মা বাবাকে। একটা মাত্র ছেলে গৌতম। একটা ওষুধ কোম্পানির সেলস্ ম‍্যানেজার। বেশ সুনাম হয়েছে। কাল জলপাইগুড়ি গিয়েছিল কাজে। আজ ফেরার পথে ফুলবাড়ির কাছে একটা ট্রাকের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ফুলবাড়ির এক নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে। ব‍্যাগের ভেতরে ছোট নোটবুক থেকে বাড়ির ফোন নম্বর পেয়ে ফোন করেছে। চোট কতটা মারাত্মক জানা যায়নি।

যাইহোক চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় সময় কাটতে লাগল। বিজনকাকু বললেন ঘন্টা খানেক তো হলো ওরা হয়তো পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। আর দশ মিনিট পরে ফোন করে শুনে নিচ্ছি পল্টুর কাছ থেকে। এই কথা বলতে বলতেই বিজন কাকুর হাতের ফোন বেজে উঠলো।
হ‍্যালো!
হ‍্যালো বিজনকাকু!
হ‍্যাঁ বল, শুনছি। কি অবস্থা গৌতমের? কতটা ইনজুরি? জ্ঞান আছে? ডাক্তার কি বলছে?
দাঁড়াও দাঁড়াও কাকু বলছি বলছি। একসঙ্গে এতো প্রশ্ন করলে উত্তর দেব কি করে!
আচ্ছা আচ্ছা বল। আসলে ভীষণ চিন্তায় আছি আমরা। গৌতমের মাকে তো সামলানো যাচ্ছনা। অজিতদা তাও চুপ করে বসে আছে।
*অজিতবাবু গৌতমের বাবা। সহজ সরল শান্ত স্বভাবের ভালো মানুষ। খবর পাওয়ার পর থেকেই চুপচাপ, কোনো প্রশ্ন নেই। শুধু বোবার মতো বসে আছে।
শোনো বিজনকাকু!
হ‍্যাঁ বল!
গৌতমের ডান পা ভেঙেছে, ডান হাতের কনুই ও ভেঙেছে। মাথা ফেটেছ একটু, ছটা সেলাই পড়েছে। সিটিস্ক‍্যানের রিপোর্টে মাথার চোটে ভয় নেই। কিন্তু পায়ের অপারেশন করতে হবে। কয়েক টুকরো হয়েছে। সন্ধ‍্যায় অপারেশন। আপাতত এমারজেন্সিতে আছে। জ্ঞান আছে, কথা বলছে, কিন্তু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার বলেছে অন‍্য কোনো ভয় নেই, তবে পা অপারেশন করার পর বোঝা যাবে কতটা কি হবে? রড বসাতে হতে পারে। একটু ভোগান্তি আছে।
যাক বাবা! স্বস্তি পেলাম শুনে। আমি এখনই জানাচ্ছি ওর বাবা-মাকে। তোরা থাকিস ওখানে। আমি আর স্বপন বিকালে যাব।

বিজনকাকু পল্টুর মুখ দেখে শোনা সমস্ত কথা বুঝিয়ে বললো অজিতদা ও বৌদিকে। বৌদি- একটু শক্ত হন, গৌতমের হাত-পা ভাঙলেও অন‍্য কোনো সাংঘাতিক ক্ষতি হয়নি। ভালো নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে, আমি শুনেছি ওখানে অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্ট খুব ভালো। গৌতম সেরে উঠবে দ্রুত।
তোমার কথা যেন সত‍্যি হয় বিজন, তোমরা পাশে থাকলেই আমরা জোর পাব।
নিশ্চয়ই বৌদি, আমরা আছি। কোনো সমস‍্যা হলেই আমাকে ডাকবেন। ভীড়ের মধ‍্যে খচড়াদাও ছিল। এতক্ষণ তার নীরবতা অবাক করার মতো। বিজনকাকুর কথা শেষ হতেই বাক‍্যের ফোয়ারা ছেটানো শুরু হলো।

বাপরে বাপ্! সব বিষয়ে এমন করে বলেন আপনারা, যেন বিশাল দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমি তো ভাবলাম কিছু একটা হয়ে গেছে। এ আর এমনকি! সামান্য পা আর হাত ভেঙেছে গৌতমের। আমি যাচ্ছি বাড়িতে, কিছু দরকার হলে খবর দিয়েন অজিতদা।
আজকে বিজনকাকু আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলনা। তুমি কি মানুষ! খগা! ছেলেটা নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। একমাত্র ছেলের এই অবস্থা। আর ওর বাবা-মায়ের সামনে তুমি এইভাবে বলতে পারলে? তোমার বিবেক বলে কিছু নেই। তুমি যাও, আশা করি তোমার মতো মানুষের সাহায্যের খুব একটা প্রয়োজন হবেনা।

অতো মেজাজ ঠিক না বিজনদা, কখন কাকে কোন দরকারে লাগে কেউ বলতে পারেনা।
দেখা যাবে, এখন মানে মানে বিদায় হও তুমি।

দিন পনেরো পরে গৌতমকে বাড়িতে আনা হয়, তিনমাস পরে প্লাস্টার কাটা হয়েছিল পায়ের, হাতেরটা মাস দেড়েক পরে। তারপর ফিজিওথেরাপি, ক্রেপ ব‍্যান্ডেজ বাঁধা নানা সাহায্যে গৌতম আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। কাজে যোগ দিয়েছে। ডান-পাটা সামান্য ছোট হয়ে গেছে। মাপ দিয়ে জুতো বানিয়ে নিতে হয়।

কথায় আছে কুকুরের লেজে যতই ঢিল বাঁধা হোকনা কেন, সোজা হয়না। খচড়াদার সাথে এই প্রবাদ একদম মিলে যায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে, কত ঘটনা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করে তোলে কিন্তু বাঁকা পথের পথিক কখনো সোজা রাস্তায় চলেনা।

গত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিকাশ জেঠু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। জেঠিমা আর জেঠু দুইজনেরই বয়স আশির উপরে। দুই ছেলেই তাঁদের বড়ো চাকরি করে। কর্মসুত্রে একজন দিল্লি আরেকজন বেঙ্গালুরু। একজন রান্নার সহায়িকা আছে খাবার বানিয়ে দেয়ার জন‍্য। আর একজন সহায়িকা আছে সকালে আসে, সারাদিন দেখেশুনে বাড়ির সব কাজ করে। সন্ধ‍্যায় বাড়ি ফিরে যায়। রাতে দুই প্রবীণ মানুষ একে অপরের ভরসায় থাকে।
শীতের দিনেই এমন ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। ভোর চারটের দিকে বিকাশজেঠু বাথরুমে গিয়েছিল, জেঠিমা ঘুমোচ্ছিলেন। ঘরে ফিরে আসতেই জেঠু পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়। জেঠিমার হঠাৎ এতো জোরে আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেতেই ধরফড় করে উঠে বসে। দেখে ঘরের দরজার সামনে জেঠু পড়ে আছে। তখন সোয়া চারটা হবে সম্ভবত। প্রথমে চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে না পেরে জেঠিমা বারান্দায় এসে-
কে কোথায় আছ তাড়াতাড়ি এসো। উনি পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। ভোরের দিকে অনেকেই প্রাতভ্রমণে বের হয়। ঠিক সেই সময় আশিসদা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। জেঠিমার চিৎকার শুনে গেটের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে।
জেঠিমা ঘরের দরজা খুলুন তাড়াতাড়ি, দেখি কি হয়েছে।
আশিসদা ভেতরে গিয়ে জেঠুকে দেখে বুঝতে পারে লক্ষণ ঠিক লাগছেনা। জেঠিমা আপনি শান্ত হোন। জেঠুকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমি আ‍্যম্বুলেন্স ডাকছি ও ক্লাবের ছেলেদের খবর দিচ্ছি। মিনিট কুড়ির মধ‍্যে বাড়ি ভর্তি লোক, আ‍্যম্বুলেন্সও এসে যায়। বিকাশজেঠুকে নিয়ে আশিসদা, পলাশদা, বিজনকাকু হাসপাতালে ছোটে। ক্লাবের জনা পাঁচেক ছেলে বাইকে রওনা হয়। হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল কলেজে রেফার করে। সিটিস্ক‍্যান রিপোর্ট খুব খারাপ। অপারেশন করলেও কিছু কাজ হবেনা। সেরিব্রাল আ‍্যটাক। রক্তের ছিটায় ভেতরে ছোপ ছোপ দেখা যাচ্ছে।
ছেলেদের খবর দেয়া হয়। সন্ধ‍্যার মধ‍্যে ছেলেরা এসে পৌঁছে যায়। কোনো জ্ঞান নেই, কোমায় চলে গেছে জেঠু। স‍্যালাইন, অক্সিজেন চলছে। দুদিনের মাথায় সব শেষ।
সন্ধ‍্যার দিকে জেঠুর মৃতদেহ বাড়িতে আনার কথা। লোকে লোকারণ‍্য উঠোন থেকে রাস্তা। যেমনটা হয়, একে অপরের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে নানা আলোচনা করছে। খচড়াদাও সেখানে উপস্থিত যথারীতি।
দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্দেশ্যে বলতে থাকল-
কি আর এমন হয়েছিল, পড়ে গিয়ে স্ট্রোকের মতো হয়েছিল , ঠিকঠাক চিকিৎসা করলে বেঁচে যেত। প্রাইভেটে ভর্তি করালে ভালো ডাক্তার দেখত। বিকাশকাকু ঠিক হয়ে যেত। ছেলেগুলো পয়সার কুমির, কিপটা। আরে এরা নাহয় মেডিকেলে ভর্তি করেছিল, কেন তোরা ফোন করে বলতে পারলিনা যে যত খরচা হয় আমরা করব, বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করুন। বড়ো চাকুরী করা ছেলে থেকে কি লাভ! বাবা-মার প্রতি কোনো দায়িত্ব যখন পালন করতে পারেনা।
স্থান-কাল-পাত্র না দেখে এমন বেফাঁস মন্তব‍্য শুনে রাগে গা রিরি করতে থাকলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিজনকাকু নিজেকে সংযত রাখল।

সামাজিক জীব হিসেবে নিজেকে মান‍্যতা দিয়ে শ্মশান যাত্রায় সঙ্গী হলো খচড়দা। কেউ বাইকে, কেউ নিজের গাড়িতে, কেউ কেউ টোটোতে করে প্রায় চল্লিশ জনের মতো লোক শ্মশানে গিয়েছিল। শীতের রাত, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মা ঠাকুরমাদের কথায় শেষযাত্রায় বৃষ্টি হলে পূণ্যের ফল বলে মনে করা হয়। যাইহোক শ্মশানে গিয়ে দেহ নামিয়ে যত লৌকিক আচার-নিয়ম পালন করা হচ্ছিল। দুইছেলে, ব্রাহ্মণ ও জনা পাঁচেক মানুষ ছিল সেখানে। এরপরেই ক্রিমেটোরিয়ামে ঢোকানো হবে। বেশ লম্বা লাইন, পাঁচ নম্বরে বিকাশজেঠু। পাশের দোকান থেকে সবাইকে গরম চা আনিয়ে দেয়া হয়েছে। সবাই চুপচাপ বসে আছে, রাত দশটা বাজে হয়তো তখন। খচড়াদা উশখুশ করছে, ছটফট করছে, অস্থির। না পারছে যেতে না পারছে থাকতে। এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে বলে খোলা জায়গায় পায়চারিও করতে পারছেনা। শান্ত পরিবেশের মাঝে দুম করে বলে বসল-

বিকাশকাকু দুদিন ধরে ভীষণ জ্বালাচ্ছে মাইরি। সেদিন অসুস্থ হলো তাও ভোরবেলা। মারা গেল প্রায় সন্ধ‍্যার দিকে। শীতের দিনে এমন ঝামেলায় ফেলল যে কি আর বলব!
পাশের বেঞ্চে বসেছিল বুলটাই। বুলটাই বেশ রগচটা ও মারকাটারি ছেলে। যেমন মানুষের বিপদে ঝাঁপ দেয় তেমন কেউ বাজে কাজ বা কথা বলে রেহাই পায়না ওর হাত থেকে। খগাদা বলেছে তো বলেছে সেই বুলটাইয়েরই সামনে। ব‍্যাস-

খগাদা ফালতু কথা বলে দিমাগ খিঁচড়ে দিওনা বলছি। তোমাকে কে আসতে বলেছিল? হয় চুপ করে বসো নাহলে কেটে পড়ো।
দেখ বুলটাই বড়োদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতে শেখ। যাকে যা মুখে আসে বলতে পারিসনা কিন্তু।
বেশি বাড়াবাড়ি কোরোনা খগাদা, কিসের বড়ো! কে বড়ো! তোমার মতো মানুষকে কেউ সম্মান দিতে পারেনা। তাই বেশি কথা না বলে রাস্তা দেখো।
বুলটাই ভালো হচ্ছেনা বলছি। খবরদার! আমার সাথে ঠিক করে কথা বল।
এককথা দুকথায় প্রায় হাতাহাতি হবার অবস্থা। বিজনকাকু, পলাশদা, স্বপনদা, আশিসদা সবাই এসে দুজনকে থামানোর চেষ্টা করে।
আশিসদা বলে-
বুলটাই মাথা ঠান্ডা কর ভাই। যে কাজে এসেছি সেটা সুষ্ঠুভাবে করাটাই কর্তব্য।
খগা তুমি কি ঠিক করে ফেলেছ জীবনে শুধরাবেনা! যেকোনো জায়গায় একটা বাজে কথা বলতেই হবে?
আপনিও বুলটাইয়ের হয়ে ঝোল টেনে কথা বলছেন বিজনদা। কি এমন খারাপ কথা বলেছি আমি?
খারাপ ভালো কিছুই বোলোনা। চুপ করে বসে থাকো, নাহলে কারও সাথে ফিরে যাও। অনেক দেরি হবে আজ।
আপনারা বললেই আমাকে ফিরে যেতে হবে নাকি? মগের মুল্লুক নাকি! আমি এখানেই থাকব।
দেখলেন তো বিজনকাকু এই মানুষটা কতটা অসভ‍্য, অভদ্র।
কি বললি বুলটাই আমি অসভ‍্য, অভদ্র!
হ‍্যাঁ তাই।
তোর এতো বড়ো সাহস। তোকে দেখে নেব।
যা দেখার দেখে নিও। এখন এখান থেকে কেটে না পড়লে সোজা নদীর ঠান্ডা জলে চুবানি খাওয়াবো। যাও ফোটো।

এবার আর খগা বসেনা, রাগে অপমানে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে হাঁটা লাগায়। দশ পা যেতে না যেতেই –
ওরে বাবারে মরে গেলাম, বলে চিৎকার।
চোটটা বেশ জোরেই লেগেছে। রাগের মাথায় বেখেয়ালে চলছিল খগাদা। সামনে থেকে কাঠের খাটিয়াতে করে একটা শবদেহ নিয়ে কিছু লোক ঢুকছিল শ্মশানে। একটু অন্ধকার থাকায় কেউই দেখতে পায়নি। খাটিয়ার কোনার সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে খগাদা। সেকেন্ডের মধ‍্যেই অঘটন।
বিশ্রামঘরে বসে থাকা সবাই শুনতে পায় চিৎকার। খগাদার গলা না! বুলটাই বলে ওঠে। চল্ তো কি হলো দেখি। ওরা তিনজন দৌড়ে যায় সেখানে।
দেখতে পায় খগাদা চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে আর কপালের ওপর থেকে সমানে রক্ত ঝরছে। বুলটাই বলে- দেবু গাড়ি স্টার্ট দে, সোজা সিভিলে চল। লোকটা সন্ধ‍্যা থেকে যা বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল! কি অবস্থা! আবার নতুন এক বিপদ।
তিনজনে খগাদাকে ধরে গাড়িতে তুলে রওনা দেয় সিভিল হাসপাতালে। সোজা এমারজেন্সিতে ঢোকে।

খগাদাকে ছুটি দেবে আজ। বুলটাই, দেবু নিতে এসেছে, সঙ্গে খগাদার ছেলে বাপি। ওদের দেখে খগাদা আস্তে আস্তে বলে প্রচন্ড ব‍্যাথা রে। কতটা ফেটেছে জানিস! আটটা সেলাই দিয়েছে। আরেকটু হলে চোখটা যেত।
দেবু বলে-
এ আর এমন কি! মাত্র আটটা সেলাই। আমরা তো ভাবলাম মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে। অপারেশন করতে হবে। একমাস আইসিইউতে রাখবে। পরে দেখলাম কিছুই তেমন হয়নি।
ওঠো চলো, ছুটি দিয়ে দিয়েছে তোমাকে। এই সামান্য চোট নিয়ে প‍্যানিক কোরোনা।

অনুশ্রী তরফদার। কবি ও সম্পাদক। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের শিলিগুড়ি। দ্রোহকাল নামক ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

পটচিত্র

পটচিত্র

  সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার…..